শরী‘আতে মাযহাব মানার গুরুত্ব এবং মাযহাব না মানার কুফল

ইসলামী জিন্দেগীসভ্যতা ও সংস্কৃতি২২ ফেব, ২১

প্রশ্ন

আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবী মুসলমানদের সম্পর্কে ইসলামী শরী‘আতের রায় কি ? শরী‘আতে মাযহাব অনুসরনের গুরুত্ব কতটুকু?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

বর্তমান ইলমী কমযোরী ও প্রবৃত্তি পূজার যামানায় সকল মুসলমানদের জন্য ইমাম চতুষ্টয়ের যে কোন এক ইমামের তাক্বলীদ করা অর্থাৎ চার মাযহাব সমূহের কোন এক মাযহাবের অনুসারী হওয়া ওয়াজিব । বর্তমানে শরী‘আতের উপর চলার আর কোন বিকল্প নেই । বাস্তব প্রমাণে দেখা গিয়ছে যে, যারা কোন ইমামের অনুসরণ না করে ‍নিজেরা সরাসরি কুরআন-হাদীস বুঝে আমল করতে তৎপর হয়েছেন, তারা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর গোলামীর পরিবর্তে নিজের নফস বা মনের গোলামী করে শরী‘আত বিবর্জিত পথে পরিচালিত হয়েছেন । মাযহাব মানা জরুরী হওয়ার কারণ হল- পবিত্র কুরআন মানুষের হিদাআতের নিমিত্তে প্রকৃত মূল কিতাব । এর ব্যাখ্যার জন্য আল্লাহপাক রাসূলে কারীম c কে প্রেরণ করেছেন ।তাই রাসূলে পাক c এর গোটা জীবনাদর্শ তথা তার সকল কথা ও কাজ কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যা স্বরূপ । ঈমাম শাফি‘ঈ i বলেন, “যদি রাসূলে পাক c -এর কথা ও কাজ আমাদের মধ্যে বিদ্যমান না থাকত, তবে কারো পক্ষে কুরআন বুঝা সম্ভবপর ছিল না । উদাহরণস্বরূপ কুরআনে নামাযের নির্দেশ এসেছে । কিন্তু কোন ওয়াক্ত কত রাকা‘আত ? এর ব্যাখ্যা কুরআনে দেওয়া হয়নি । হাদীসে এর ব্যাখ্যা এসেছে । অনুরূপভাবে যাকাত প্রদানের নির্দেশ এসেছে । কিন্তু কি মালের কি পরিমাণ যাকাত কতদিন মাল হাতে থাকলে দিতে হবে ? এসবের ব্যাখ্যা কুরআনে দেওয়া হয়নি । হাদীসে এর ব্যাখ্যা এসেছে । সে ব্যাখ্যা অনুযায়ী মুসলমানগণ আমল করে আসছেন ।

তবে এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো-আমলী হুকুমের ব্যাপারে প্রায় ক্ষেত্রেই এমন একাধিক হাদীস বিদ্যমান, যে সবের ভাবধারা বাহ্যতঃ পরষ্পর বিরোধী । এর কারণ হল- শরী‘আতের হুকুম-আহকাম সবগুলো একত্রে নাযিল হয়নি । বরং তখন মানুষের ক্রমানুগতিতে ইসলাম গ্রহণ ও আমলী দৃঢ়তা অর্জনের প্রেক্ষিতে হুকুম-আহকাম পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে নাযিল হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে । যেমন- ইসলামের প্রথম যুগে নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত ছিল না । আবার যা ছিল তাও দু’ রাকা‘আত করে ছিল । উপরন্তু তখন নামাযের ভিতর কথা-বার্তা বলা জায়িয ছিল । অতঃপর পর্যায়ক্রমে হুকুম নাযিল হয়ে পরিবর্তিত হতে থাকে । শেষ পর্যন্ত পূর্বের হুকুম রহিত হয়ে বর্তমান স্বরূপে এসে পৌঁছে । তেমনিভা্বে হিযরতের পরে প্রথম যখন রোযার হুকুম নাযিল হয় তখন রোযা রাখা অবধারিত ফরয হিসেবে সাব্যস্ত ছিল না । বরং তখন রোযা না রেখে এক একটি রোযার পরিবর্তে একজন করে মিসকীনকে দু’বেলা খানা খাওয়ানোরও অনুমতি ছিল । অতঃপর পরবর্তীতে রোযা রাখাকেই অবধারিত ফরজ ঘোষণা করে পূর্বের হুকুম রহিত করা হয় । এমনিভাবে বিভিন্ন হুকুম-আহকামে পর্যায়ক্রমে রদবদল হলো, কোনটা আগের কোনটা পরের এবং কোন হাদীস সর্ব বিবেচনান্তে আমলের অধিক যোগ্য এ পরবর্তী যামানায় সকল বিষয়ের সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ও দুঃসাধ্য ব্যাপার । এসব বিষয়ে যে সকল আহলে ইলমগণ সমাধান ‍দিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে অনেক মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ।

এ অবস্থায় এখন কি সকলেই নিজেদের ইচ্ছামাফিক মত গ্রহণ করে আমল করবে, না রাসূলুল্লাহর c নিকটবর্তী যামানার কোন বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন অধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্বের গবেষণার ভিত্তিতে ফয়সালার উপর আমলকারী হবে ? নিজের ইচ্ছামত আমল গ্রহণ করলে তা তো শরী‘আত পালন হলো না বরং নিজের নফসের গোলামীই করা হয় । তাই এ সকল মতভেদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমল করতে হবে নিশ্চই কোন যোগ্য মুজতাহিদ আহলে ইলমের গবেষণালব্ধ পথ অবলম্বন করে । তাই এখন সেই নির্ভরযোগ্য মুজতাহিদ আহলে ইলমকে বেছে বের করতে হবে । এ ব্যাপারে চার মাযহাবের মুজতাহিদ ইমামগণ উলামায়ে উম্মাতে মুহাম্মদীর নযরে সর্বসম্মতিক্রমে যোগ্য মুজতাহিদ আহলে ইলম হিসেবে গ্রহণীয় হয়েছেন । কারণ-প্রথমতঃ তারা যামানায়ে রিসালাতের নিকটতম ইলমী জোয়ারের সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন । দ্বিতীয়ত তারা প্রত্যেকেই মজতাহিদে কামিল, পবিত্র কুরআন-হাদীস ও ইজমা সম্পর্কে অনন্য গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন । তাঁদের যুগে তাঁদের পরবর্তী যুগ হতে বর্তমান যুগ পর্যন্ত তাদের মত কুরআন ও হাদীসে পারদর্শী মুজতাহিদ দ্বিতীয় আর পয়দা হয়নি । তাই তাদের গবেষণা ইজতিহাদে নির্ণীত কুরআন-হাদীসের সার-আমলই পরবর্তী সকল মুসলমানদের জন্য পালনীয় সাব্যস্ত হয়েছে । তাঁরা আজীবন গবেষণা করে ইসলামের নিয়ম-নীতির যে রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন, তা সকলের নিকট গ্রহণীয় হিসেবে স্থির পেয়েছে । তারা হুকুম-আহাকাম ও মাসায়িলের ব্যাপারে এমন কতগুলো মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন যে, সেগুলোর নিরিখে কিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভুত সকল মাসায়িলের সমাধান করা যেতে পারে । এজন্য মুতাআখখিরীন উলামায়ে কিরামগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, ইমাম চতু্ষ্টয়ের পরবর্তী যামানার লোকদের জন্য তাঁদের যে-কোন এক ইমামের তাক্বলীদ (অর্থাৎ তার গবেষণার ভিত্তিতে শরয়ী হুকুম-আহকাম পালন করা ওয়াজিব । এ কারণেই বর্তমান চার মাযহাবের মধ্য হতে কোন এক মাযহাবের তাক্বলীদ ও অনুসরণ ওয়াজিব।)

অতএব, বর্তমানে এরূপ যারা মাযহাব বর্জন করে সরাসরি কুরআন-হাদীস বুঝে আমল করতে তৎপর হবেন, তারা নিজ প্রবৃত্তির অনুসারী সাব্যস্ত হবেন । আহলে হাদীস নামধারী লোকেরা কিভাবে শুধু কুরআন-হাদীসের যাহিরী বিষয়বস্তুর উপরে আমলকারী হতে চান, আমাদের তা বোধগম্য নয় । কারণ- বর্তমান আধুনিক যামানায় এমন অনেক বিষয়ের উদ্ভব হয়েছে, যার হুকুমের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ উল্লেখ কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই । যেমন উড়োজাহাজে নামায পড়া যাবে কি-না ? বীমা ইন্সুরেন্স জায়িয হবে কি-না ? এ ধরনের প্রচুর বিষয় রয়েছে । অতএব এ সকল মাসাইলের ব্যাপারে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনগণের উসূলভিত্তিক ও গবেষণালব্ধ ফায়সালা মেনে নেওয়া ব্যতিরেকে গত্যান্তর আছে কি ? তাই নফসানী খাহিশাতের ইত্তিবা না করে কোন এক মাযহাব গ্রহণ করে নেয়াই কর্তব্য । নতুবা শরী‘আত মানার নামে নিজের নফসের গোলামী করা হবে-যা গোমরাহীর পথ তা কখনোও কাম্য নয় । কারণ মানুষ স্বাভাবিকতঃ যেটা সহজ, যা তার স্বার্থের অনুকূলে সেটাকেই গ্রহণ করতে চেষ্টা করে । বর্তমানে আহলে হাদীসগণ তাই করে আসছে । চার মাযহাবের কোন মাযহাবের অনুসারী নন বলে তারা ওয়াজিব তরককারী হয়েছেন এবং বর্তমান যামানার আহলে হাদীসগণ আকাবীরগণকে গালী গালাজ ও মুকাল্লিদীনদের প্রতি কুধারণা রাখার কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকে খারিজ । তবে তারা ইসলামের গন্ডি বহির্ভূত বলে পরিগণিত হবেন না । [আহসানুল ফাতাওয়া ১ঃ ৪১১]

অধুনা আরেক শ্রেণীর আধুনিক আলেমের আবির্ভাব ঘটেছে । তাদের দাবী-তাক্বলীদ তো করতে হবে । কিন্তু কোন এক ইমামের তাক্বলীদ করতে হবে, এটা কোন জরুরী নয় । বরং তাদের রিসার্চ ও গবেষণা অনুযায়ী যে মাসআলায় যে ইমামের মত গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে, সেটাই তারা গ্রহণ করবেন । নির্দিষ্ট কোন ইমামকে তারা মানতে প্রস্তুত নন । গভীর ভাবে চিন্তা করলে এদের মধ্যে আর আহলে হাদীসদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায় না । শুধু নামের পার্থক্য । কারণ, তাদের এ মতের কারণে অনেক ক্ষেত্রে শরী‘আতের ইত্তেবার নামে নফসের গোলামীর শিকার হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে । যেমন ধরুন-উযু করার পরে কারোর শরীর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হল, তিনি বললেন- যে, যদিও ইমাম আবূ হানিফার i মাযহাবে এতে উযু ভঙ্গ হয়ে যায় । কিন্তু এ ব্যাপারে আমার নিকট ইমাম শাফিয়ী i -এর মাযহাব নির্ভরযোগ্য মনে হয় । সুতরাং তিনি উযু করলেন না । কিছুক্ষণ পরে কোন কারণ বশতঃ কোন বেগানা মহিলাকে স্পর্শ করে ফেললেন এবং মন্তব্য করলেন যে যদিও এতে ইমাম শাফিয়ী i -এর মাযহাবে উযু নষ্ট হয়, কিন্তু এ ব্যাপারে ইমাম আবূ হানিফা i -এর মাযহাব আমার নিকট নির্ভরযোগ্য মনে হয় ।

সুতরাং এক্ষেত্রেও তিনি উযু না করে বেঁচে গেলেন এবং নামায আদায় করলেন । এখন যদি উভয় ইমামের নিকট এ ব্যক্তির নামায সম্পর্কে ফাতাওয়া চাওয়া হয়, তাহলে নিশ্চয় উভয় ইমাম এই ফাতাওয়া দিবেন যে, ঐ ব্যক্তি বিনা উযুতে নামায পড়েছে । সুতরাং তার নামাযই হয় নি । অথচ ঐ ব্যক্তি দাবী করছে যে, সে উভয় ইমামকে মান্য করেছে এবং মাযহাব মতে নামায পড়েছে । তাই নির্দিষ্ট কোন এক ইমামের ইকতিদাই জরুরী ।

- والله اعلم باالصواب -

সূত্র

  • ইমদাদুল মুফতীন, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৫১
  • জাওয়াহিরুল ফিকহ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১২৭
  • কিফায়াতুল মুফতী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩২৫

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২২ ফেব, ২১