উত্তর আমেরিকায় কিবলার দিক প্রসঙ্গে

ইসলামী জিন্দেগীবিবিধ২২ ফেব, ২১

প্রশ্ন

উত্তর আমেরিকার কিবলার দিক নিয়ে স্থানীয় মুসলমানগণ চরম বিভ্রান্তির শিকার। দীর্ঘদিন হতে এখানকার মুসলমানগণ দক্ষিণ পূর্ব দিকে কিবলা জেনে আমল করে আসছে। ইদানিং কিছু লোক এর বিপরীত উত্তর-পূর্ব দিককে কিবলা বলতে শুরু করায় এ দ্বিধা দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে।

আমি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা। দিক নির্ণয়ই আমার বিশেষ দায়িত্ব ছিল। বর্তমানে আমি উত্তর আমেরিকায় অবস্থান করছি। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমি উত্তর আমেরিকার কিবলা উত্তর পূর্বদিকে হওয়াটা গলদ মনে করি। অথচ স্থানীয় মুসলমানগণ এ ব্যাপারে চরম পেরেশানীতে ভুগছে। বিজ্ঞ মুফতীয়ায়ে কিরামের খেদমতে আরয, এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে রাহনুমায়ী করবেন।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

قال الله تعال: قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَه- سورة البقر: ١٤٤

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما بين المشرق والمغرب قبلة- عن ابى حنيفة رحم الله تعال: المشرق قبلة اهل المغرب والمغرب قبلة اهل المشرق والجنوب قبلة اهل الشمال والشمال قبلة اهل الجنو: كذا فى تبيين الحقائق ص: ١/١ج١

উপরোল্লেখিত আয়াত হাদীস এবং ইমামে আ’যম ইমাম আবূ হানীফা i -এর উসূল থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা গেল যে, যে সকল লোকেরা সরাসরি বায়তুল্লাহকে সম্মুখে রেখে নামায পড়ছে তাদের জন্য বায়তুল্লাহ শরীফই কিবলা। আর ‍যারা বায়তুল্লাহ শরীফ থেকে দূরে অবস্থান করছে তাদের জন্য সরাসরি বায়তুল্লাহ শরীফ কিবলা নয়। বরং বায়তুল্লাহ শরীফের দিক কিবলা। তাদের নামাযে কা‘বা শরীফের দিকে মুখ ফিরানো ফরয। সুতরাং যারা কাবা শরীফের উত্তরাঞ্চলে অবস্থান করছে তাদের কিবলা দক্ষিণ দিকে আর যারা কাবা শরীফের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থান করছে তাদের কিবলা উত্তর দিকে। তদ্রুপ পূর্বাঞ্চলে যাদের আবাস পশ্চিম ‍দিকে তাদের কিবলা আর পশ্চিমাঞ্চলে যাদের আবাস পূর্ব ‍দিকে তাদের কিবলা।

উল্লেখিত দিকগুলো কিভাবে জানা যাবে এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী- وَعَلَامَاتٍ وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ • তিনি পথ নির্ণয়ক বহু চিহ্ন সৃষ্টি করেছেন এবং তারকা দ্বারাও মানুষ পথের সন্ধান পায়। -সূরা নাহল-১৬ وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا • তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্রসমূহ সৃজন করেছেন । যাতে তোমরা স্থল ও জলের অন্ধকারে পথপ্রাপ্ত হও। -সূরা আন‘আম-৯৭ قال رسول الله صلي الله عليه وسلم ان خيار عباد الله الذين يراعون الشمس والقمر و النجوم الاظلة لذكر الله • আলোচিত আয়াত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত হল যে, আল্লাহ তা‘আলা চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রকে দিক ‍নির্ধারণের মাধ্যম বানিয়েছেন। এ কারণে হযরত সাহাবায়ে কিরাম ও আকাবিরে উম্মাত বাইতুল্লাহ থেকে দূরবর্তী শহরে কিবলার দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বর্ণিত নিদর্শন ও মাধ্যমের সাহায্য নিতেন। সর্বস্তরের ও সর্বস্থানের মুসলমান অধিবাসীদের জন্য অতি সহজে কিবলার দিক নির্ণয় উপরোক্ত বাহ্যিক নিদর্শনসমূহের উপর ভিত্তি করেই সম্ভব। انا امة امية لا نكتب و لانحسب (মিশকাত শরীফ, ১৭৪) উক্ত হাদীস থেকেও বুঝা গেল যে, কিবলার দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রকাশ্য আলামত সমূহের উপরই নির্ভর করা চাই। সেগুলোকে বাদ দিয়ে জ্যামিতিক সূক্ষ হিসাব-নিকাশ এবং যন্ত্রের পিছে পড়া শরী‘আতের ভাবমূর্তির পরিপন্থী। এ ব্যাপারে উলামাদের আমল থেকেও জানা যায় যে, যখন কখনো জ্যামিতিক হিসাব বা যন্ত্র দ্বারা নির্ধারণকৃত কিবলার দিক শরী‘আতের গ্রহণযোগ্য সাদাসিধে উসূলের ভিত্তিতে নির্ধারণকৃত কিবলা পরিপন্থী বা ভিন্নতর মনে হয়েছে, তখন প্রথমোক্ত কিবলা প্রত্যাখ্যাত বিবেচিত হয়েছে এবং শেষোক্ত কিবলা চুরান্ত ও গৃহীত হয়েছে। যেমনটি দামেশকের মসজিদে উমাইয়া, মিশরের মসজিদে আমর ইবনুল ‘আস e -এর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ যে হিসাবের উপর ভিত্তি করে যে কিবলা বের করা হয়েছিল তা পুরাতন কিবলা থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকাশ পেয়েছে। তথাপি অদ্যবধি সে পুরাতন কিবলারই অনুসরণ করা হচ্ছে। মিশরের রাষ্ট্রপতি আহমদ বিন তুলূন জ্যামিতিক হিসাব করে যে কিবলা নির্ধারণ করেছেন সেটা মসজিদে আমর ইবনুল আসের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছিল । উক্ত কিবলার উপর আমল করাকে উলামায়ে কিরাম খিলাফ আউলা তথা অনুত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। -জাওয়াহিরুল ফিকহ্ , ১ঃ২৬০

সারকথা, কুরআন-হাদীস এবং উলামায়ে কিরামের আমলের দ্বারা এটা প্রমাণ হয় যে, কা‘বা হতে দূরবর্তী শহরের কিবলার দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্র প্রভৃতি মোটা মোটা নির্দেশনের উপর ভিত্তি করাই হল শরী‘আতের ভাব সম্মত।

জ্যামিতিক হিসাব-নিকাশ ও যন্ত্রাদির সাহায্য গ্রহণ করা শরী‘আতের পছন্দনীয় নয়। ‍সুতরাং যেখানে পুরাতন মসজিদ বিদ্যমান, যেহেতু এর কিবলার দিক মোটা মোটা নির্দেশনের উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত। তাই নতুন করে এর কিবলা নির্ণয়ের পরিবর্তে পুরাতন কিবলা অনুসরণ করাই জরুরী।

মুফতীয়ে ‘আযম মুহাম্মদ শফী i এ প্রসঙ্গে বিষদ আলোচনার পর লিখেছেন- সারকথা হল কিবলার দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যন্ত্রাদি এবং হিসাবের সাহায্য নেয়া পূর্বসূরীদের নীতি ছিলনা। শরী‘আতও এর নির্দেশ দেয় নি। কোন অবস্থায় এর প্রয়োজনও নেই। বরং পূর্বসূরীদের নিয়মনীতি হল, যে এলাকায় পুরাতন মসজিদ আছে সে স্থানে সেগুলোরই অনুসরণ করতে হবে। আর যে স্থানে পুরাতন মসজিদ নেই সেখানে নক্ষত্রাদি এবং অন্যান্য মোটা মোটা নিদর্শনের মাধ্যমে কিবলার দিক নির্ণয় করবে। -জাওয়াহিরুল ফিকহ্ , ১ঃ২৬৭

অবশ্য যে স্থানে পুরাতন মসজিদ নেই, সে স্থানে যন্ত্রাদি এবং জ্যামিতিক হিসেবের সাহায্য নেয়া এ ব্যাপারে পারদর্শী ব্যক্তির জন্য জায়িয হবে। তবে শর্ত হল চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্র প্রভৃতি প্রকাশ্য ‍নিদর্শনের সাহায্যে নির্ণয়কৃত কিবলার যেন খিলাফ না হয়। খিলাফ হলে সেক্ষেত্রে প্রথমোক্ত কিবলা অগ্রাহ্য হবে এবং দ্বিতীয়টাই বলবত থাকবে। এসকল কথা ফাতাওয়া শামী ১ঃ৪৩০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে ।

উপরোল্লেখিত বিষদ আলোচনার আলোকে যদি উত্তর আমেরিকা এবং কানাডার অধিবাসীদের কিবলার দিক সম্পর্কে চিন্তা করা হয় তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের কিবলা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হবে। এর একাধিক কারণ রয়েছে।

১. ‘রিসালায়ে তাছবীতে আহলে হক’ নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, হিজরী প্রথম শতাব্দীর প্রায় শেষের দিক হতেই উত্তর আমেরিকার মুসলামানদের যাতায়াত ও বসতি শুরু হওয়ায় এবং খৃষ্টাব্দ ১৯৭০ এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত সেখানকার মসজিদ ও ঈদগাহ সমূহের মিহরাব পূর্ব-দক্ষিণ দিকেই ছিল।

২. যেহেতু মক্কা শরীফ কর্কটক্রান্তি থেকে কয়েক ডিগ্রী দক্ষিণ দিকে অবস্থিত, এদিকে উত্তর আমেরিকা কর্কটক্রান্তি থেকে অনেক ডিগ্রী উত্তর দিকে অবস্থিত সুতরাং সূর্য চলার কক্ষপথের দ্বারা প্রমাণ হয় য়ে, উত্তর আমেরিকাবাসীদের কিবলার দিক অবশ্যই দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হবে।

৩. ফুকাহাদের নিকট দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সব থেকে মযবুত দলীল ধ্রুব তারকা। যেহেতু ধ্রুব তারকা উত্তর আমেরিকায় যথেষ্ট উঁচুতে অর্থাৎ মাথা বরাবর দৃষ্টিগোচর হয়। আর মক্কা শরীফে সে তারকা উত্তর দিকে যথেষ্ট নিচে থাকে। অতএব এর দ্বারাও বুঝা গেল উত্তর আমেরিকা মক্কা শরীফ থেকে তুলনা মূলক উত্তর দিকে অবস্থিত। আর পশ্চিম দিকে হওয়াতো সুস্পষ্ট। সুতরাং উত্তর আমেরিকা বাসীদের জন্য কিবলার দিক দক্ষিণ-পূর্ব দিক হওয়া আবশ্যক। -তাছবীতে আহলে হক, ১২

অনেকে উত্তর আমেরিকার কিবলা ‍উত্তর পূর্বদিক বলেন। আমাদের ‍দৃষ্টিতে এটা সঠিক নয়। কেননা, তারা এর প্রমাণ স্বরূপ দূরত্বের কম-বেশ এবং জ্যামিতিক হিসাবকে মূলভিত্তি বানান। যা আকাবিরের নিয়মের খিলাফ এবং শরী‘আতের ভাবমূর্তির পরিপন্থী।

তাছাড়া উত্তর আমেরিকার কিবলা উত্তর-পূর্ব দিকে বলার মধ্যে একটি বড় খারাবী হল, সে সূরতে উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা উভয় স্থানের কিবলা এক হয়ে যায়। অথচ এটা অসম্ভব। কেননা দক্ষিণ আমেরিকা যেমন আর্জেন্টিনা প্রভৃতি এলাকার কিবলার দিক উত্তর পূর্ব হওয়া স্বতঃসিদ্ধ এবং মধ্য আমেরিকার কিবলা সম্পূর্ণ পূর্ব ‍দিকে। এখন যদি উত্তর আমেরিকার কিবলাও উত্তর-পূ্র্ব দিকে হয় তখন উত্তর-দক্ষিণ দু’টো দিকের কিবলাই এক দিকে হয়ে যায় যা ‍নিশ্চিত ভুল। এ ভুল থেকে মুক্তির জন্য উত্তর আমেরিকার কিবলা দক্ষিণ-পূর্ব ‍দিক হওয়া আবশ্যক। যাতে উত্তর-দক্ষিণ উভয় দিকের মধ্যে পার্থক্য প্রকাশ পায়। তবে যদি তাদের কিবলার দিক সঠিক কিবলার থেকে ৪৫ ডিগ্রির ভিতরে হয় যদিও সেটা উত্তর আমেরিকার সহীহ কিবলা নয়, তবুও সেদিক ফিরে নামায পড়লে নামায সহীহ হয়ে যাবে। ৪৫ ডিগ্রি থেকে বেশী হলে নামায সহীহ হবে না। এটাই আামাদের তাহকীক। বিশ্বের অন্যান্য উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে বিচার-বিশ্লেষণ করলে ভাল হয়।

উল্লেখ্য, আমাদের এ যাবৎ আলোচনা আলাসকা শহর ছাড়া অন্যান্য শহরের জন্য প্রযোজ্য। কেননা, জিরো পয়েন্টের রেখা যদি লন্ডনের উপর ধরার পরিবর্তে সরাসরি কাবা শরীফের উপর মানা হয় এবং মুসলমানদের জন্য সেটাই জরুরী। তখন আলাসকা শহর পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধের মধ্যে পড়বে। তাই এ শহরের কিবলা দক্ষিণ-পশ্চিমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। শর‘ই নিয়ম নীতির দাবী এটাই যে, বাইতুল্লাহ শরীফই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং ‍দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বায়তুল্লাহকেই জিরো পয়েন্ট মানতে হবে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ • নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মু’মিনের জন্য বানানো হয়েছে- সেটা হচ্ছে এ কা‘বা ঘর। যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হিদায়াত স্বরূপ। -সূরা আল-ইমরান, ৯৬

এমনিভাবে বুখারী শরীফে আছে, ইয়ামানকে ইয়ামান এজন্য নামকরণ করা হয়েছে যেহেতু সেটা কা‘বা শরীফের ডানে অবস্থিত। আর শামকে শাম এজন্য নামকরণ করা হয়েছে যেহেতু সেটা কা‘বা শরীফের বামে অবস্থিত।

- والله اعلم باالصواب -

সূত্র

  • বুখারী শরীফ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪৯৬

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২২ ফেব, ২১