মসজিদের স্থায়ী ইমামের ইমামতীর জন্য কি কি গুণ থাকা জরুরী? স্থায়ী ইমামের প্রতি মুসল্লিদের বা মহল্লাবাসীদের কি হক থাকে। পক্ষান্তরে মুসল্লিদের বা মহল্লাবাসীদের প্রতি ইমাম সাহেবের কি হক আছে? বিস্তারিত জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -
ইমামতীর জন্য কয়েকটি সিফাত বা গুণ থাকতে হয় যথা- (১) মুসলমান হওয়া, (২) বালিগ হওয়া, (৩) জ্ঞানী হওয়া, (৪) পুরুষ হওয়া, (৫) কারী ও আলেম হওয়া। অর্থাৎ শুদ্ধভাবে কিরাআত পাঠে সক্ষম এবং নামাযের জরুরী মাসাইল সম্পর্কে অভিজ্ঞ। (৬) মুত্তাকী হওয়া অর্থাৎ সকল প্রকার হারাম ও মাকরূহ তাহরীমী ও বিদ‘আতী কাজ থেকে বেচে থাকা (৭) শর‘ই উযর থেকে মুক্ত হওয়া, যেমন-বোবা, তোতলামী ইত্যাদি না হওয়া। মোদ্দাকথা শরী‘আতের পূর্ণ অনুসরণ করা এবং তার উপর সর্বদাই অটল থাকা। [প্রমাণঃ ফাতাওয়া শামী ১ঃ৫৫০, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৭ঃ৬২]
উল্লেখিত শর্তসমূহ না পাওয়া গেলে তাকে ইমাম পদে নিয়োগ দান করা জায়িয হবে না। বিশেষ করে কোন ফাসিক ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে নিয়োগ করা বা বহাল রাখা জায়িয নয়। তেমনি ফাসিকের পিছনে নামায পড়া মাকরূহে তাহরীমী। এ ধরনের ব্যক্তির জন্য ইমামতী করাও নাজায়িয।
ফাসিক বলা হয় যারা গুনাহে কবীরায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যেমন দাঁড়ি কেটে ছেটে এক মুষ্টির কম করে রাখা। মিথ্যা কথা বলা বা খেয়ানত করা। পর্দা না মানা, সিনেমা-টেলিভিশন প্রভৃতি দেখা। গান-বাদ্য শুনা, ঘরে জীবজন্তুর ছবি বা মূর্তি স্থাপন করা। বেপর্দা মহিলাদের ঝাড় ফুঁক করা। [প্রমাণঃ ফাতাওয়া মাহমূদিয়া ২ঃ৭৭, # মারাকিল ফালাহ, ১৬৩, # ফাতাওয়ায়ে শামী ১ঃ৫৫৯, # ইমদাদুল মুফতীন ৩১৯]
ইমাম যেহেতু নায়েবে নবী সুতরাং নবী-রাসূলগণের যে তিনটি কাজ ছিল তাবলীগ, তালিম ও তাযকিয়া (সূরা বাকারা ১২৯, ১৫১, জুম‘আ ২) এগুলো প্রথমে তার মধ্যে হাসিল করতে হবে। এর প্রত্যেকটা গুণকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিদের নিকট থেকে শিখতে হবে। নিজের যিন্দেগীকে উক্ত তিন যিম্মাদারী আদায় করার জন্য ওয়াকফ করতে হবে। সুতরাং ইমাম হিসেবে তিনটি যিম্মাদারী পালন করতে হবে।
প্রথম যিম্মাদারীঃ মসজিদের মুসল্লীদের সঠিকভাবে ইমামতী করা ও নামায পড়ানো। এর জন্য দু’টি কাজ করতে হবে।
(ক) সূরা-কিরাআত পুরাপুরি সহীহ করতে হবে। কারণ, কিরাআতের অনেক ভুল দ্বারা নামায ফাসিদ হয়ে যায়।
(খ) সহীহ মাসআলা-মাসাইল, আমলী মশক ও বাস্তব অনুশীলন-এর মাধ্যমে শিখে নিতে হবে। কারণ, ইমামের অনেক ভুলের কারণে সকলের নামায নষ্ট হয়ে যায়। যেমন মনে মনে কিরাআত পড়া। জিহবা, ঠোট বা মুখ না হেলিয়ে দিলে দিলে কিরাআত পড়া। [হিদায়া ১ঃ১১৭]
দ্বিতীয় যিম্মাদারীঃ মসজিদের মুসল্লীদের এবং মসজিদের মকতবের বাচ্চাদেরকে কুরআনে কারীম তথা সূরা-কিরাআত সহ দীনের বিষয়সমূহ পর্যায়ক্রমে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা। দীনের করণীয় পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান দান করা। অর্থাৎ তাদের ঈমান-আকায়িদ, ইবাদাত-বন্দেগী, মু‘আমালাত বা হালাল রিযিক, মু‘আশারাত বা বান্দার হক ও ইসলামী সামাজিকতা, আত্মশুদ্ধি বা অন্তরের রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে সমস্ত গুনাহের অভ্যাস পরিত্যাগ করান এবং প্রত্যেকটি বিষয় বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হাতে কলমে শিক্ষাদান করা। এমন যেন না হয় যে, একজন ইমাম ১০/১৫ বৎসর একস্থানে ইমামতী করছেন অথচ তাঁর পেছনের মুসল্লিদের সূরা-কিরাআত, নামাযের রুকু ও সিজদাহ কিছুই সহীহ হয়নি। অথচ তিনি ইমামতী করেই যাচ্ছেন।
তৃতীয় যিম্মাদারীঃ মহল্লার সকল শ্রেণীর লোকদেরকে দীনী ও দুনিয়াবী ফায়দা পৌঁছানোর লক্ষ্যে সময় সুযোগমত তাদের খোঁজ-খবর নেয়া এবং তাদের বাড়ীতে বাড়ীতে পৌঁছাতে চেষ্টা করা। একজন ইমাম ইচ্ছা করলে এক বৎসরে সারে তিনশত বাড়ীতে পৌঁছতে পারেন। এর জন্য ইমাম সাহেবের নিকট সম্পূর্ণ মহল্লার লোকদের একটা তালিকা থাকা উচিৎ। উক্ত তালিকা অনুযায়ী যারা মসজিদে আসেন তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজের সহকর্মী বানিয়ে তাদের সাথে পরামর্শক্রমে যার সাথে যার পরিচয় আছে তাকে রাহবার বানিয়ে তার সহযোগিতায় সেসব লোকের বাড়ীতে পৌঁছা। অতঃপর তাদের কাছে দীনের গুরূত্ব তুলে ধরা। তাদের পরিবারের মহিলাদেরকেও দীনী দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদেরকেও সহীহ ইমান ও আমলের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। সাথে সাথে মহল্লার গরীব লোকদের খোঁজ-খবর নেয়া। বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো। বর্তমানে আমাদের অবহেলার দরুন মসজিদের মকতব বন্ধ হয়ে দুশমনদের ফাঁদ কিন্ডার গার্ডেন আবাদ হচ্ছে। সুযোগ থাকতে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
মুসল্লিদের উপর ইমামের হক হল যেহেতু তিনি সরদার বা নায়েবে নবী তাই তাকে সম্মান প্রদর্শন করা। তাঁকে বিপদ-আপদে হাদিয়া-তোহফা দিয়ে সাহায্য করা এবং তার সুখে-দুঃখে খোঁজ-খবর নেয়া এবং তার দীনী কথা সমূহকে যথাযথভাবে মেনে চলা। তার সাথে বেয়াদবী বা অসম্মানজনক আচরণ থেকে বিরত থাকা। কোন ভুলভ্রান্তি দেখলে আদবের সাথে গোপনে তাকে জানানো।
- والله اعلم باالصواب -