“যদি আলী না থাকতো তাহলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত” একথার মানে কি

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসবিবিধ২০ এপ্রিল, ২২

প্রশ্ন

এক শিয়া প্রশ্ন করেছে- হযরত উমর e বলেছেন- “যদি আলী না থাকতো তাহলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত”। যা একথা প্রমাণ করছে যে, হযরত উমর e এর ইলমী যোগ্যতা খুবই কম ছিল। শরীয়তের আলেম ছিলেন না। বরং এদিক থেকে হযরত আলী e এবং অন্যান্য সাহাবাগণ আরো অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন। তাই তিনি খিলাফতের যোগ্যতা রাখতেন না। এ কারণেই হযরত উমর e বলতেন, যদি আলী না থাকতো, তাহলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত। শিয়াদের এ দাবির ব্যাপারে আপনাদের ব্যাখ্যা কামনা করছি। আল্লাহ তাআলা আপনাদের দ্বীনী খিদমাতকে কবুল করুন।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

শিয়া কাফেরদের এ মিথ্যাচার বুঝার জন্য বিষয়টি ভাল করে বুঝতে হবে। যা নিচে উদ্ধৃত করা হলঃ প্রথম কথা হল ইসলামের খলীফা যেসব গুণাবলীর প্রতি লক্ষ্য করে নির্বাচিত করা হয়, তাহলো- ন্যায়পরায়নতা, ধার্মিকতা, খোদাভীরুতা, দ্বীনের ইলম এবং শরয়ী মাসায়েল সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা সেই সাথে নেতৃত্ব, দেশ পরিচলানায় পারদর্শীতা ও শরয়ী বিধান প্রয়োগ করার মত যোগ্যতা থাকা। এক্ষেত্রে এ শর্ত জরুরী নয় যে, ইসলামের খলীফা শরীয়তের সমস্ত বিষয় সম্পর্কে সর্বদিক থেকে অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ হবেন। দু’ একটি বিষয়ও তার ইলমের বাইরে হবে না এমন ব্যক্তির কথা চিন্তা করা বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। এ বিষয়ে কয়েকটি প্রমাণ পেশ করা হল,- হযরত আলী e । যাকে আমরা আহলে সুন্নত যেমন ন্যায়পরায়ন খলীফা স্বীকার করি, তেমনি শিয়ারাও ন্যায়পরায়ন খলীফা স্বীকার করে। আমরা যেমন বলি তিনি ইসলামী শরীয়তের আলেম ছিলেন, একথা শিয়ারাও স্বীকার করে। আমরা যেমন তাকে যোগ্য খলীফা বিশ্বাস করি, তেমনি শিয়ারাও স্বীকার করে। অথচ হযরত আলী e এর ব্যাপারে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে যাতে প্রমাণিত হয় যে, খলীফার জন্য শরয়ী বিষয়ের সকল শাখা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ইলম থাকা জরুরী নয়। যেমন- ক) عَنْ عِكْرِمَةَ، أَنَّ عَلِيًّا حَرَّقَ قَوْمًا ارْتَدُّوا عَنِ الإِسْلاَمِ، فَبَلَغَ ذَلِكَ ابْنَ عَبَّاسٍ، فَقَالَ: لَوْ كُنْتُ أَنَا لَقَتَلْتُهُمْ بِقَوْلِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ. وَلَمْ أَكُنْ لأُحَرِّقَهُمْ لِقَوْلِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لاَ تُعَذِّبُوا بِعَذَابِ اللهِ، فَبَلَغَ ذَلِكَ عَلِيًّا، فَقَالَ: صَدَقَ ابْنُ عَبَّاسٍ. হযরত ইকরিমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত আলী e এর কাছে ধর্মত্যাগীদের উপস্থিত করা হল, তখন তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেললেন, এ সংবাদ হযরত ইবনে আব্বাস e এর কাছে পৌঁছল, তখন তিনি বললেন, যদি আমি হতাম, তাহলে আমি তাদের পুড়িয়ে ফেলতাম না রাসূল c এর এ নিষেধাজ্ঞা কারণে যে, “তোমরা আলাহর শাস্তি দিয়ে শাস্তি দিওনা”। বরং আমি তাদের হত্যা করতাম। কারণ আলাহর নবী c বলেছেন-“যে ব্যক্তি ধর্ম পাল্টায় তাকে হত্যা কর”। একথা হযরত আলী e এর কাছে পৌঁছলে তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস সত্য বলেছে। -সুনানে তিরমিজী, ১/২৪৪-২৪৫, হাদীস নং-১৪৫৮ খ) একবার হযরত আলী e এর কাছে এক ব্যক্তি মাসআলা জিজ্ঞাসা করল, তখন হযরত আলী e এর জবাব দিলেন। তখন উক্ত ব্যক্তি বলতে লাগল, এ মাসআলাটি আসলে আপনি যেমন বলেছেন এমন নয় বরং এমন। লোকটির জবাব শুনে হযরত আলী e বললেন, তুমি ঠিকই বলেছো। আমিও চমকে গেছি প্রতিটি জ্ঞানীর চেয়ে অন্যজন বেশি জ্ঞানী হয়ে থাকে। উক্ত ঘটনাটি কানযুল উম্মালে নিচে উদ্ধৃত শব্দে এসেছে- عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ كَعْبٍ الْقُرَظِيِّ قَالَ: سَأَلَ رَجُلٌ عَلِيًّا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ مَسْأَلَةٍ، فَقَالَ فِيهَا, فَقَالَ الرَّجُلُ: لَيْسَ كَذَلِكَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنْ كَذَا وَكَذَا فَقَالَ عَلِيٌّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: «أَصَبْتَ وَأَخْطَأْتُ وَفَوْقَ كُلِّ ذِي عِلْمٍ عَلِيمٌ» (كنز العمال، رقم الحديث-29517، جامع بيان العلم وفضله، رقم الحديث-865 এরকম আরো অনেক ঘটনা কিতাবাদীতে পাওয়া যায়। যা প্রমাণ করে, সবার সব সময় সকল মাসআলা জানা থাকতে হবে একথাটি একটি বোকামীসূলভ বক্তব্য। খোদ হযরত আলী e তার কিতাব নাহজুল বালাগাতে বলেন- “আমি ভুল করা থেকে নিরাপদ নই। আমি আমার কর্ম বিষয়ে ভুল করা থেকে নিশ্চিন্ত নই। তবে যদি আল্লাহ তাআলা আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে ভিন্ন কথা। কারণ তিনি আমার থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাশীল। (নাহজুল বালাগাহ-১/৪৩৭, খুতবায়ে আলী e ) মূল বক্তব্যটি এমন- فلا تكفوا عن مقاله بحق او مشوره بعدل فانى لست فى نفسى بفوق ان اخطى ولا امن ذالك من فعلى الا ان يكفى الله من نفسى ما هو املك به منى (نهج البلاغة-1/437 উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, কিছু মাসায়েলে না-জানা বলাটা, কিংবা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ভুল করার কথা স্বীকার করা, নিজের কথাকে বাদ দিয়ে অন্যের কথাকে গ্রহণ করে নেয়াটা কোন দোষণীয় বিষয় নয়। নয় সমালোচনা করার বিষয়ও। উপরোক্ত দৃষ্টিকোণ হিসেবে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা বর্ণনা করা হয়। এক ব্যাভিচারিনী মহিলাকে হযরত উমর e রজম করার জন্য হুকুম দেন। তখন হযরত আলী e জানতে পারলেন উক্ত মহিলাটি গর্ভবতী। যা হযরত উমর e জানতেন না। তখন হযরত আলী e বিষয়টি হযরত উমর e কে জানান। বলেন, আপনার হুকুমতো এ মহিলার উপর আরোপিত হতে পারে, কিন্তু আপনার হুকুমটি এ মহিলার পেটে থাকা বাচ্চার ক্ষেত্রেতো আরোপ হতে পারে না। হযরত আলী e এর কথা শুনার পর উমর e তার কথা মেনে নিলেন। বললেন- “যদি আলী না থাকতো তাহলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত”। তাহলে কি বুঝা গেল? হযরত উমর e মহিলাটি গর্ভবতী একথা জানতেন না। আর হযরত আলী e কথাটি জানতেন। তাই তিনি বিষয়টি হযরত উমর e কে জানিয়ে অনেক বড় ভুল করা থেকে রক্ষা করেন। ভুল থেকে বাঁচানোর শুকরিয়া স্বরূপ বিনয়ীতা প্রকাশ করে হযরত উমর e একথা বলেছেন। এর দ্বারা হযরত আলী e কে সম্মান জানিয়েছেন, তাকে মুবারকবাদ দিয়েছেন। এটাই ভদ্র ও জ্ঞানীদের স্বাভাবিক প্রকৃতি। উক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে হযরত উমর e স্বীয় ইনসাফ ও লিল্লাহিয়্যাতে চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এরকম আরো ঘটনা রয়েছে যাতে হযরত উমর e ইনসাফ ও লিল্লাহিয়্যাতের মুর্তপ্রতীক হিসেবে প্রতিয়মান হন। আরেকটি ঘটনা হযরত আবু সুফিয়ান বলেন, আমাকে আমার মাশায়েখরা বর্ণনা করেছেন যে, এক ব্যক্তি হযরত উমর e এর খেদমতে আসলো। বলতে লাগল, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি আমার স্ত্রী থেকে দুই বছর দুরে ছিলাম। কিন্তু এসে দেখি সে গর্ভবতী হয়ে গেছে। ( এ কারণে আমার স্ত্রী শাস্তির উপযুক্ত) তখন হযরত উমর e উক্ত মহিলাকে রজম করা বিষয়ে পরামর্শ করলেন। তখন হযরত মুয়াজ বিন জাবাল e বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! মহিলাটিকে রজম করার অধিকার আপনার আছে, তবে তার পেটে যে আছে তার ব্যাপারে আপনার অধিকার নেই। তাই সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত রজমকে মুলতবী করুন। তারপর হযরত উমর e সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত রজমের হুকুমটি মুলতুবী করে দেন। তারপর উক্ত মহিলা একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেয়, যার সামনের দাঁত বের হয়ে গিয়েছিল। অভিযোগকারী ব্যক্তিটি উক্ত শিশুতে নিজের সাদৃশ্যতা দেখতে পায়। আর বলতে লাগল- কাবার রবের কসম! এ বাচ্চাটি আমার! এ দৃশ্য দেখে হযরত উমর e বললেন, মহিলারা মুয়াজ বিন জাবাল e এর মত ব্যক্তিত্ব প্রসব করতে অক্ষম হয়ে গেছে। যদি মুয়াজ না থাকতো, তাহলে উমর ধ্বংস হয়ে যেতো। -সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-১৫৫৫৮, সুনানে দারা কুতনী-৩/৩২২, কিতাবুন নিকাহ, কাহেরা থেকে প্রকাশিত, দিল্লির আনসারী প্রকাশনী-২/৪২৫, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, কিতাবুল হুদুদ-১৫/৮৮ নিচের শব্দে উক্ত বর্ণনাটি হাদীসের কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে- عَنْ أَبِي سُفْيَانَ، حَدَّثَنِي أَشْيَاخٌ مِنَّا قَالُوا: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فَقَالَ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ إِنِّي غِبْتُ عَنِ امْرَأَتِي سَنَتَيْنِ فَجِئْتُ وَهِيَ حُبْلَى فَشَاوَرَ عُمَرُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ نَاسًا فِي رَجْمِهَا فَقَالَ مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: ” يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ إِنْ كَانَ لَكَ عَلَيْهَا سَبِيلٌ فَلَيْسَ لَكَ عَلَى مَا فِي بَطْنِهَا سَبِيلٌ فَاتْرُكْهَا حَتَّى تَضَعَ “، فَتَرَكَهَا فَوَلَدَتْ غُلَامًا قَدْ خَرَجَتْ ثَنَايَاهُ فَعَرَفَ الرَّجُلُ الشَّبَهَ فِيهِ فَقَالَ: ابْنِي وَرَبِّ الْكَعْبَةِ, فَقَالَ عُمَرُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: ” عَجَزَتِ النِّسَاءُ أَنْ يَلِدْنَ مِثْلَ مُعَاذٍ لَوْلَا مُعَاذٌ لَهَلَكَ عُمَرُ “ মোটকথা হল, হযরত উমর e হযরত মুয়াজ বিন জাবাল e এর পরামর্শ গ্রহণ করে তাকে সম্মানিত করেছেন। তার কদর করে উক্ত বক্তব্যটি বলেছেন। এর দ্বারা শুধুমাত্র নিজের লিল্লাহিয়্যাত ও বিনয়তা সেই সাথে সৎ পরামর্শককে কদর জানানো ছাড়া আর কী? এটাই একজন ন্যয়নিষ্ট, নীতিবান শাসকের নীতি। উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা একথাই পরিস্কার হয়েছে যে, ন্যায়নিষ্ট যোগ্য শাসক হওয়ার জন্য সর্ব বিষয়ে সর্বদা অভিজ্ঞ থাকা শর্ত নয়। যা হযরত উমর e এবং হযরত আলী e এর বিভিন্ন সময় অজানা বিষয়ের প্রকাশ দ্বারাই প্রতিভাত হচ্ছে। হক জানার সাথে সাথে তা গ্রহণ করার মানসিকতা এ উভয় ব্যক্তিত্বের মহানতা, ইনসাফপূর্ণ মানসিকতা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণবাহী। তাই এসব বিষয়কে সামনে এনে কাউকে ছোট করা ও অপমান করার মানসিকতা খুবই নিচু মনের কাজ ছাড়া কিছু নয়। আর যেহেতু এমন ঘটনা হযরত আলী e থেকেও প্রমানিত। সেখানে শুধু হযরত উমর e কেই কেন অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু বানানো হল? কোন বিষয় সম্পর্কে না জানা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, অযোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে থাকে, তাহলে একই দোষেতো হযরত আলী e ও দোষী সাব্যস্ত হয়ে যান। কিন্তু হযরত আলী e এর বিরুদ্ধে কোন কিছু না বলে (আমরা যেমন হযরত উমর e এর বিরুদ্ধাচারণ ও সমালোচনাকে হারাম মনে করি, তেমনি হযরত আলী e এর সমালোচনা ও বিরুদ্ধাচরণকে হারাম মনে করি) শুধু হযরত উমর e এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন দেখেই পরিস্কার বুঝা যায়, অভিযোগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি এক রোখা। যা কিছুতেই ইনসাফপূর্ণ নয়। আমাদের কাছে হযরত উমর e যেমন মান্যবর। তেমনি হযরত আলী e ও মান্যবর। হযরত উমর e এর সমালোচনা করা যেমন জায়েজ নয়, তেমনি হযরত আলী e এর সমালোচনা করাও জায়েজ নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের শিয়া কাফেরদের ষড়যন্ত্র থেকে সাধারণ মুসলমানদের দ্বীন ও ঈমানকে হিফাযত করুন। আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২০ এপ্রিল, ২২