“নবীকে সৃষ্টি করা না হলে কোন কিছুই সৃষ্টি হতো না” মর্মের বক্তব্যটি কি হাদীস

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসসিরাত ও ইতিহাস৯ মে, ২১

প্রশ্ন

মানুষের মুখে প্রচলিত কথা যেগুলোকে হাদীস বলে প্রচার করা হয়। যেমন “নাবী c কে সৃষ্টি না করলে কিছুই সৃষ্টি করা হত না”। এটা কি হাদীস? যদি জাল হাদীস হয় তাহলে কি কি কারণে জাল?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

এ বক্তব্য নির্ভর একাধিক হাদীস প্রসিদ্ধ। যথা- لولاك لما خلقت الأفلاك তথা, যদি আপনাকে সৃষ্টি না করা হতো, তাহলে আমি আসমানসমূহ (কোন কিছুই) সৃষ্টি করতাম না। এ শব্দে হাদীসটি জাল ও বানোয়াট এতে কোন সন্দেহ নেই। -রিসালাতুল মাওযুআত, ৯; তাযকিরাতুল মাওযূআত, ৮৬; আলমাসনু, ১৫০; কাশফুল খাফা, ২/১৬৪; আল লাউলউল মারসূ, ৬৬; আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআ, ২/৪১০; আল বূসীরী মাদেহুর রাসূলিল আযম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ৭৫

لو لا محمد ما خلقتك তথা যদি মোহাম্মদ c না হতো, তাহলে তোমাকে (আদম কে সৃষ্টি করা হতো না। যেসব কিতাবে এ হাদীসটি বর্ণিত আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৫০২, আল মুজামুস সগীর লিত তাবরানী, হাদীস নং-৯৯২, এছাড়া আরও রয়েছে আবু নুআইম i এর দালায়েলুন নাবুয়্যাহ, ইমাম বায়হাকী i এর দালায়েলুন নাবুয়্যাহ, আদ দুরার কিতাবে ইবনে আসাকীর i , এবং রয়েছে মাযমাউজ যাওয়ায়েদ কিতাবে।

এ বিষয়ে আমরা মুহাদ্দিসগণের উক্তিগুলো আগে দেখে নেই-

১. আল্লামা হাকেম i বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। -মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, বর্ণনা নং-৪২২৮

২. ইমাম বায়হাকী i বলেন, আব্দুর রহমান বিন জায়েদ বিন আসলাম এ বর্ণনায় মুনফারিদ। আর তিনি জঈফ বর্ণনাকারী। -তারীখে দামেশক, ৭/৪৩৭; দালায়েলুন নবুয়্যাহ, ৫/৪৮৯

৩. আল্লামা ইবনে তাইমিয়া i বলেন, এটি মারফূ এবং মাওকুফ উভয় হালাতে বর্ণিত। -মাজমূয়ুল ফাতাওয়া, ১/২৫৪

৪. আল্লামা ইবনে তাইমিয়া i আরো বলেন, হযরত উমর e এর সূত্রে এটি মারফূ এবং মাওকুফ উভয় সূত্রে বর্ণিত। এ সূত্রে আব্দুর রহমান বিন জায়েজ বিন আসলাম রয়েছেন। যিনি সর্বসম্মতভাবে জঈফ রাবী। আর তিনি প্রচুর ভুল করতেন। -আততাওয়াসসুল ওয়াল ওসীলাহ, বর্ণনা নং ১৬৬

৫. আল্লামা ইবনে কাসীর i বলেন, এতে আব্দুর রহমান বিন জায়েদ বিন আসলাম রয়েছে। আর তার ব্যাপারে কালাম রয়েছে। ৬ আল্লামা হায়সামী i বলেন, এর সূত্রে এমন সব ব্যক্তি রয়েছে যারা মারূফ নন। -মাযমাউজ যাওয়ায়েদ, ৮/২৫৬

৭. আল্লামা সানআনী i বলেন, এটি কিভাবে সহীহ তা আমার জানা নেই। -আলইনসাফ ফী হাকীকাতিল আওলিয়া, ৯৬

৮. আল্লামা জাহাবী i বলেছেন, হাদীসটি বাতিল। -মীযানুল ই’তিদাল, ২/৫০৪

৯. আল্লামা কাসতাল্লানী i দলীলযোগ্য হিসেবে তা উপস্থাপন করেছেন।(আল মাওয়াহেবুল লাদুনিয়্যাহ, ২/৫২৫)

১০. আল্লামা সুবকী i তা দলীলযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। (শেফাউস সিকাম)

যাইহোক, মোটকথা হল এ হাদীসটির সনদ নিয়েও বিস্তর কালাম রয়েছে। এটি খুবই দুর্বল একটি হাদীস। মুহাদ্দিসীনদের বিশাল জামাত যাকে জাল ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে অনেকেই এটির সনদ সঠিক বলে মত দিয়েছেন। যেমন মুস্তাদরাকে হাকেম প্রণেতা। আবার অনেকে এটি জঈফ বলেছেন কিন্তু জাল বলে মন্তব্য করেননি। এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী i লিখেছেন- لولاك لما خلقت الأفلاك” قال الصغانى انه موضوع كذا فى الخلاصة، لكن معنها صحيح، فقد روى الديلمى عن ابن عباس رضى الله عنهما مرفوع: اتانى جبريل فقال يا محمد لولاك ما خلقت الجنة ولولاك ما خلقت النار، وفى رواية ابن عساكر لولاك ما خلقت الدنيا • “যদি তোমাকে সৃষ্টি না করা হতো, তাহলে আসমানসমূহ তথা কোন কিছুই সৃষ্টি করা হতো না” বক্তব্যটির ব্যাপারে আল্লামা সাগানী i বলেছেন এটি মওজু। যেমনটি রয়েছে খুলাসাতে। কিন্তু এর অর্থটি সহীহ। দায়লামী ইবনে আব্বাস e থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেছেনঃ আমার কাছে জিবরাঈল আসল, তারপর বলল, হে মুহাম্মদ! যদি আপনাকে সৃষ্টি না করা হতো, তাহলে আমি জান্নাত সৃষ্টি করতাম না, যদি তোমাকে সৃষ্টি না করা হতো, তাহলে জাহান্নাম সৃষ্টি করতাম না। ইবনে আসাকীরের বর্ণনায় এসেছে, যদি তোমাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না। -আলমাওযূআতুল কাবীর-১০১

দু’টি প্রশ্ন উত্তর যারা উপরোক্ত হাদীসকে জাল বলে থাকেন। তারা এটি জাল হওয়ার উপর দু’টি যুক্তিও পেশ করে থাকেন। যথা-

১. এ হাদীসটি কুরআনে কারীমের বিপরীত। কারণ কুরআন দ্বারা প্রমাণিত যে, হযরত আদম কে আল্লাহ তাআলা কিছু বাক্য শিখিয়েছিলেন, যখন তিনি তা পড়েছেন, তখন আল্লাহ তাআলা তার তওবা কবুল করেছেন। আল্লাহ তাআলার বাণী- فَتَلَقَّىٰ آدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ • অতঃপর হযরত আদম স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি (করুণাভরে) লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহা-ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু। -সূরা বাকারা, আয়াত নং-৩৭ অথচ এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, আদম রাসূল c এর ওসীলায় দুআ করেছেন, তারপর তার তওবা কবুল হয়, তাহলেতো এ হাদীস কুরআনের বিপরীত। তাই এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূল c এর হাদীস আল্লাহ তাআলার বাণীরই ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। আমরা কুরআনের ব্যাখ্যা সর্ব প্রথম রাসূল c এর হাদীস দ্বারাই গ্রহণ করে থাকি। কুরআনে কারীমে একথা রয়েছে যে, হযরত আদম কে কিছু কালিমা আল্লাহ তাআলা শিক্ষা দিয়েছেন, যা পড়ার দরূন তার তওবা কবুল হয়েছে। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হযরত আদম কে তওবার ওসীলা কালিমা শিক্ষা দেয়াটা ছিল একটি নেয়ামত। আর নেয়ামত সাধারণত কোন নেক আমলের কারণে পাওয়া যায়। হযরত আদম এর পাওয়া তওবার অসীলা সেসব কালিমা শিখতে পাওয়ার নেয়ামত কোন নেক আমলের কারণে পেয়েছিলেন? তা কুরআনে বর্ণিত নেই। হাদীসের মাঝে সেই নেক আমলের কথাটি বর্ণনা করা হয়েছে। সেই নেক আমলটি হল, হযরত আদম রাসূল c এর ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন। সুতরাং এ হাদীসটি কুরআনে কারীমের বিপরীত অর্থবোধক রইল কিভাবে? -শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ প্রণীত তাফসীরে ফাতহুল আজীজ-১/১৮৩

২. আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, মানুষ ও জীন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে ইবাদতের জন্য। আর বাকি সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের উপকারের জন্য। অথচ এ হাদীসে বলা হচ্ছে রাসূল c কে সৃষ্টি করার কারণে সব কিছুকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাহলে কুরআনে কারীমে আয়াতের বিপরীত হয়ে গেল হাদীসটি। তাই এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

আসলে এ অভিযোগটিও যথার্থ নয়। কারণ মাকসাদ ও কারণ দু’টি ভিন্ন বস্তু। একটি অন্যটির পরিপূরক হয়। ভিন্ন হয় না। এক স্থানে মাকসাদ বলাটা তার কোন কারণ না থাকার বিরোধী হয় না। যেমন কোন বড় আলেমকে কেউ দাওয়াত দিলে। উক্ত আলেমকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি এখানে কেন এসেছেন? তাহলে উক্ত আলেম যদি জবাব দেয় যে, ওমুক ব্যক্তি আমাকে দাওয়াত দিয়েছে তাই তার সাথে দেখা করতে এসেছি। তারপর যদি প্রশ্নকারী আলেমকে বলে যে, আপনি মিথ্যা বলছেন কেন? আপনিতো এখানে এসেছেন বয়ান করতে। তাহলে কেন বলছেন ওমুকে দাওয়াত দিয়েছে তাই এসেছেন? এক্ষেত্রে কী জবাব হবে?

আসলে আলেম সাহেবের কথাটিই সঠিক। তবে প্রশ্নকারী মূল বিষয়টি না বুঝার কারণে উল্টো প্রশ্নটি করেছে। মূলত উক্ত স্থানে আলেম সাহেবের আসার কারণ দাওয়াতদাতার সাথে দেখা করা। আর মাকসাদ হল বয়ান করা। কারণ আর মাকসাদ দু’টি ভিন্ন হওয়া মূল বিষয়টি ভিন্ন হওয়ার প্রমাণ নয়। বরং একই বস্তুতে কারণ ও মাকসাদ ভিন্ন হতে পারে। তেমনি দুনিয়া সৃষ্টির কারণ যদি বলা হয় রাসূল c কে সৃষ্টি আর মাকসাদ যদি বলা হয় ইবাদত। তাহলে আয়াত ও হাদীসের মাঝে কোন বৈপরীত্ব থাকে না। একটি অপরটির বিপরীতও হয় না।

শেষ কথা এ হাদীসটি নিয়ে বিস্তর কালাম আছে। তাই বিজ্ঞ হাদীস বিশারদদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জেনে নেয়া উচিত। উপরোক্ত বক্তব্যগুলো কোন চূড়ান্ত বক্তব্য নয়। বড়দের থেকে তাহকীক করিয়ে নিলে সবচে’উত্তম হয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের হককে হক ও বাতিল বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ৯ মে, ২১