হেদায়া কিতাব কুরআনের মত একটি বিভ্রান্তি নিরসন

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসবিবিধ১৭ মে, ২১

প্রশ্ন

হেদায়ার মুকাদ্দিমায় লিখা রয়েছে যে, الهداية كالقرآن তথা হেদায়া কুরআনের মত। এটা বলে হেদায়া যেটা সৃষ্টির লেখা সেটাকে স্রষ্টার কালামের সাথে সমতায় আনা হয়নি? সৃষ্টির কথা স্রষ্টার কথার সমতুল্য হয় কি করে?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

হেদায়া ৩য় খণ্ডের শুরুতে আব্দুল হাই লৌখনবী i হেদায়া কিতাব সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যার নাম দিয়েছেন, মুকাদ্দামাতুল হিদায়া। এই প্রবন্ধটির প্রারম্ভে তিনি পর্যায়ক্রমে হেদায়ার মুসান্নিফের জীবনী এবং হেদায়া কিতাবের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি হেদায়া কিতাবের প্রশংসা করতে গিয়ে অজ্ঞাত একজন লোকের কবিতার একটি পঙক্তি উল্লেখ করেছেন। পংক্তিটি হল, إن الهداية كالقرآن قد نسخت- ما صنفوا قبلها في الشرع من كتب • পুরোটার অর্থ হল, ”আরে! হেদায়া কিতাব তো কোরআনের মতো, (এই অর্থে যে) তা মাসলা-মাসায়েল নিয়ে লিখা পূর্বের সকল কিতাবকে রহিত করে দিয়েছে।”

প্রশ্নকারীর প্রশ্ন দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, এ উপমাটিতে সমতা রয়েছে। অর্থাৎ হেদায়া ও কুরআন সমমানের। (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহ ও তার সৃষ্টির লেখা বস্তুটির মাঝে উপমা দেয়া সমতাটি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত। অভিযোগ উত্থাপনকারী উক্ত অভিযোগে তিনটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। যথা-

১. তার উপর আবশ্যক ছিল যে, প্রথমে এ উপমাটি ইলমে লুগাত বা ইলমে বয়ানের বিষয় নয়, বরং এটি ফিক্বহের মাসআলা একথা প্রমাণিত করা। সেই সাথে উক্ত বক্তব্যটিকে তাদের দাবি অনুসারে শুধু কুরআন বা হাদীসের সহীহ, সরীহ ও বৈপরীত্বহীন বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত করা। কিন্তু এ বিষয়টি না তারা প্রমাণিত করেছে, না কখনো করতে পারবে। তাহলে কী দাঁড়াল? ইলমে লুগাত (আভিধানিক বিদ্যা) বা ইলমে বয়ানের (অলংকার শাস্ত্র) বিষয়কে ফিক্বহী মাসআলা বলে প্রথমেই একটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।

২. দ্বিতীয়ত তার উপর দায়িত্ব ছিল যে, কুরআনের আয়াত বা সহীহ, সরীহ হাদীস দিয়ে একথা প্রমাণিত করা যে, মুশাব্বাহ (যাকে সাদৃশ্য করা হয়) আর মুশাব্বাহবিহী (যার দ্বারা সাদৃশ্যায়ন করা হয়) এ উভয়ের মাঝে সমতা থাকে তা প্রমাণিত করা। কিন্তু একথা প্রমাণিত করতেও ইনশাআল্লাহ পুরো গায়রে মুকাল্লিদ ফিরক্বা অক্ষম। তাই একথা প্রমাণিত না করে তিনি আরেকটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।

৩. তৃতীয়ত দায়িত্ব ছিল একথা প্রমাণিত করা যে, আল্লাহর সিফাত এবং বান্দার বানানো বস্তুর মাঝে তাশবীহ তথা উপমা দেয়া না জায়েজ। এ দাবিটিও কোন আয়াত বা সহীহ সরীহ হাদীস দিয়ে প্রমানিত করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু তিনি তা করেন নি। সুতরাং বুঝা গেল যে, উল্লেখিত বক্তব্যটিকে কুরআন ও হাদীসের বিরোধী সাব্যস্ত করার জন্য তিনটি জলজ্যান্ত মিথ্যা-প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। আর আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ • তথা মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশম্পাত। -সূরা আলে ইমরান-৬১

তাহলে কী দাঁড়াল? ফিক্বহের উপর অভিযোগ করার জন্য তিনটি অভিশাপের গর্ত খোড়া হয়েছে। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। ইবারতটির ব্যাখ্যা তাশবীহ তথা উপমা লুগাত তথা অভিধানবীদদের কাছে এক বস্তু আরেক বস্তুর সাথে অর্থগত অংশিদারিত্বের নাম। এতে মুশাব্বাহ তথা যাকে উপমা দেয়া হচ্ছে ও মুশাব্বাহবিহী তথা যার দ্বারা উপমা দেয়া হচ্ছে এ দুইয়ের মাঝে সমতা উদ্দেশ্য হয় না। উদ্দেশ্য হয় না উভয়টি একই মানের হওয়ার উপরও।

যেমন বলা হয় যে, জায়েদ বাঘের মত। এ উপমায় জায়েদ ও বাঘ সমান সমান একথা উদ্দেশ্য নয়। পূর্ণাঙ্গ সাদৃশ্যও উদ্দেশ্য নয়। এটাও উদ্দেশ্য নয় যে, জায়েদ পুরোপুরি বাঘের গুনাবলীর অংশিদার। যদি তাই হয়, তাহলেতো গায়রে মুকাল্লিদরা একথা বলার পর বাঘের লেজ আছে বলে উপমার কারণে জায়েদেরও লেজ তালাশ করতে থাকবে। বাঘের পা চারটি বলে উপমা দেয়ার কারণে জায়েদের চার পা তালাশ করতে শুরু করে দিবে। এসব করলে এটা আহমকী ছাড়া আর কী হতে পারে?

তাহলে এখানে উদ্দেশ্য কী সেটা বুঝতে হবে। শুধুমাত্র বাহাদুরীর ক্ষেত্রে জায়েদ এবং বাঘটির অংশিদারিত্ব বুঝানো উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। তারপর ও বাহাদুরীর মাঝেও সমতা উদ্দেশ্য হয় না। কেননা, অধিকাংশ সময় মুশাব্বাহবিহী এর তুলনায় মুশাব্বাহ এর তাশবিহকৃত গুণটি কম হয়ে থাকে।

যেমন বাহাদুরীর ক্ষেত্রে বাঘ অবশ্যই ব্যক্তি জায়েদ থেকে বেশি। আবার কখনো কখনো অপ্রসিদ্ধ বস্তুকে প্রসিদ্ধ বস্তুর সাথে তাশবীহ বা উপমা দেয়া হয়ে থাকে। যেমন কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে যে, مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ তথা তাঁর (আল্লাহর) নূরের উপমা হল একটি কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত। -সূরা নূর-৩৫

এবারতো গায়রে মুকাল্লিদ কথিত আহলে হাদীস ভাইদের শোরগোল শুরু করে দেয়ার কথা যে, নূর হল আল্লাহ তাআলার। যেটি গায়রে মাখলুক। অথচ সেটিকে মাখলুকের বানানো প্রদীপের সাথে কেন তাশবীহ তথা উপমা দেয়া হল? আর এ উভয়ের মাঝে সমতা হল কিভাবে?

এরকম বোকামীসূলভ অভিযোগ কেউ উত্থাপন করলে জ্ঞানীরা অবশ্যই জবাবে বলবে যে, জনাব অভিযোগকারী সাহেব! আপনি তাশবীহ এর অর্থই বুঝেন না। বুঝলে এমন বোকামী সূলভ অভিযোগ উত্থাপন করতেন না। উপমার মাঝে মুশাব্বাহ সর্বদা মুশাব্বাহবিহীর সম মানের হয় না। এমনিভাবে কেউ যদি বলে যে, দরূদে ইবরাহিমীতে আমরা প্রতিদিন নামাযে পড়ে থাকি যে, صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَآلِ إِبْرَاهِيمَ তথা রহমাত বর্ষণ করুন মুহাম্মদ c এর উপর এবং তার পরিবার পরিজনের উপর যেমনিভাবে আপনি রহমাত বর্ষন করে ইবরাহীম এবং তার পরিবার পরিচনের উপর।

তাহলে এখানে কী হচ্ছে? আমরা প্রতিদিন নামাযের মাঝে রাসূল c এর উপর রহমত বর্ষণকে তাশবীহ দিচ্ছি হযরত ইবরাহীম এর উপর রহমত বর্ষণের সাথে। তাহলে কি এখানে মুহাম্মদ c এবং হযরত ইবরাহীম কে সমান সমান বানিয়ে দেয়া হচ্ছে? নিশ্চয় আকলমন্দ ব্যক্তি এর জবাবে বলবেন যে, ইবরাহীম এর উপর আল্লাহ তাআলার রহমত বর্ষণের কথা অধিক প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণে এখানে রাসূল c এর উপর রহমত বর্ষণকে তাশবীহ দেয়া হয়েছে। সমতা বলার জন্য নয়। বা সর্বদিক থেকে উভয়জন সমমানের একথা বুঝানোর জন্য নয়।

উপরোক্ত বক্তব্যগুলো বুঝে থাকলে এ অভিযোগের জবাব আশা করি যে কেউ বের করে নিতে পারবেন। উপরোক্ত উপমাগুলোর ন্যায় এখানেও “হেদায়া কুরআনের মত” বলে বুঝানো হয়েছে যে, কুরআন যেমন পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থকে রহিত করে দিয়েছে। ঠিক তেমনি আল্লাহ তাআলা হেদায়া কিতাবকে এমন মাকবূলিয়্যাত দিয়েছেন যে, হেদায়ার পূর্বে লিখিত হানাফী ফিক্বহের উপর লেখা প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য কিতাবগুলোর স্থান সেভাবে দখল করে নিয়েছে। যেমনিভাবে পবিত্র কুরআন পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের স্থান দখল করে নিয়েছে।

মোটকথা “হেদায়া কুরআনের মত” এ তাশবীহ তথা উপমা দেয়া হয়েছে প্রসিদ্ধি রহিতকরণ ও জনসাধারণ্যের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে। অন্য কোন বিষয়ে নয়। অবশ্য অধিকাংশ সময় মুশাব্বাহবিহীর মাঝে অজহে শিবা তথা যা দিয়ে তাশবীহ বা উপমা দেয়া হচ্ছে উক্ত বস্তুটি মুশাব্বাহ এর তুলনায় বেশি থাকে। এ বিষয়টি উল্লেখিত তাশবীহের মাঝে ও হয়েছে। এ কারণেই কুরআন তার পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতাকে সম্পূর্ণ রহিত করে দিয়েছে। আর হেদায়া কিতাবটি পূর্ববর্তী হানাফী কিতাবগুলোর জনপ্রিয়তাই কেবল হ্রাস করেছে। অন্য কিছু নয়।

সুতরাং এ উপমাটির মাঝে কোনভাবেই কুরআনে কারীমের সম্মানহানী করা হয়নি। সেই সাথে কুরআনের সাথে সমতার দাবিও করা হয়নি। এরকম মিথ্যা অভিযোগ কম আকল আর বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই কেবল করতে পারে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীনে ইসলামের উপর মিথ্যা অপবাদকারীদের অপপ্রচার থেকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৭ মে, ২১