সহবাস ছাড়া তালাক দিলে মোহর কতটুকু

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসবিবাহ-তালাক২৭ নভেম্বর, ২৩

প্রশ্ন

আমার পরিচিত এক ব্যাক্তি বিদেশে থাকে, তার মা-বাবা তারবিয়ের বিষয়ে একটি মেয়ের ব্যপারে তার সাথে আলোচনা করেএবং সে মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে তার মত চায়, কিন্তু ছেলে তার মা-বাবাকে অসম্মতি জানায়। এতদসত্বেও তার মা-বাবা মেয়ে পক্ষের সাথে বিয়ের কথা-বার্তা পাকা করে ফেলে এবংছেলে পক্ষ ও মেয়ে পক্ষ  একত্রিত হয়ে তাকে ফোন করে জানায় যে, এই মুহুর্তে তোমার বিয়ে। ছেলে প্রথমে সরাসরি অসম্মতি জানালেওকিন্তু সে মুহুর্তে তার মায়ের মনে আঘাত পাবে ভেবে (মনেমনে অসম্মতি থাকলেও) চুপ থাকে এবং বিয়ে করে ফেলে। এখন তার জানার বিষয় হচ্ছেঃ

১. মোবাইলে বিয়ে কতটুকু শুদ্ধ হয়েছে?

২. ছেলেটি প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই এ বিয়েতে রাজি ছিল না, যার কারণে ছেলেটি মানষিকভাবে খূব টেনশনে আছে, এখনো এ বিয়েতে সে খুশি না এবং বিয়ের অল্প দিন পরে তার মা-বাবাও অনুভব করতে পেরেছে যে, উক্ত মেয়েটিকে তাদের সন্তানের বউ হিসেবে আনাটা উচিৎ হয়নি। কারণ, মেয়ের মাথার মধ্যভাগে চুল নাই যা ছেলের জানা থাকলেও মা-বাবা জানতো না, বিয়ের পরেই তাদের কাছে তা প্রকাশ পেয়েছে। (উল্লেখ্য যে, মেয়ের পরিবার ছেলের পারিবারিক সম্মানে দিক দিয়ে নিম্ন মানের। তা ছাড়া গ্রামেরলোকজনের সাথে তাদের (মেয়েপক্ষ) তেমন একটা সম্পর্কও ভালনা)।

৩. এই মুহুর্তে যদি মেয়েকে তালাক দিতে চায় তা কতটুকু  শরী’আতসম্মত হবে।

৪. আর তাদের মধ্যে যেহেতু এখনও মেলা-মেশা হয়নি সেহেতু মেয়েকে তালাক দিতে চাইলে শরী’আত মত কতটুকু বৈধ হবে, তালাক দিলে তার দেনমোহর পরিপূর্ণ আদায় করতে হবে কি? দয়া করে এ সমস্যাগুলোর সমাধান শর’য়ী দৃষ্টিকোন তেকে জানিয়ে বাধিত করবেন। একটি বিশেষ অনুরোধ যে, উত্তরটি একটু সহসাত পেলে উপকৃত হতাম।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

বিয়ে কোন ছেলেখেলা নয়। যখন ইচ্ছে করে ফেলা হল, আর যখন ইচ্ছে ভেঙ্গে দেয়া হল। বিবাহ একটি ইবাদত। এটি আমাদের নবীজী c এর সুন্নত। বিয়েকে এভাবে হাস্যকর বস্তু, খেলনার বস্তু বানিয়ে নেয়া কিছুতে উচিত হয়নি। জোর করে বিয়ে করিয়ে দেয়া, তারপর আবার নিজেরাই অপছন্দ করা এরকম গর্হিত আচরণ করা উক্ত ছেলের পিতা মাতার জন্য কিছুতেই উচিত হয়নি। প্রথমেই ঘর ভাল কি না? এসব যাচাই করে নেয়া উচিত ছিল। এভাবে মানসিক চাপ প্রয়োগ করে ছেলেদের বা মেয়েদের বিবাহে বাধ্য করা কিছুতেই উচিত নয়। যারা সংসার করবেন, তাদেরও পছন্দ ও অপছন্দ রয়েছে। তাই পিতা মাতার যবরদস্তি একটি অতিরঞ্জন ছাড়া আর কিছু নয়। ভবিষ্যতে এসব বিষয়গুলো খেয়াল রাখার পরামর্শ থাকবে। এবার উত্তরগুলো খেয়াল করুন। ১ নং এর জবাব মোবাইলে কি পদ্ধতিতে বিবাহ হয়েছে সেই পদ্ধতিটি পরিস্কার না জানালে বিবাহটি শুদ্ধ হয়েছে কি না? এটি বলা সম্ভব নয়। আগে বিবাহ পড়ানোর পদ্ধতি পরিস্কার ভাষায় জানাতে হবে। তারপর এ বিষয়ে সমাধান জানানো যাবে। সাধারণত দুই পদ্ধতিতে মোবাইলে বিবাহ হয়ে থাকে। যথা- ক) মোবাইলে বর কনেকে বা কনে বরকে প্রস্তাবণা পেশ এবং কবুল বলার মাধ্যমে। খ) বর বা কণে মোবাইলের মাধ্যমে বর বা কণের পাশে থাকা কোন ব্যক্তিকে বিবাহ পড়ানোর জন্য উকিল নিযুক্ত করে দেয়। তারপর উক্ত উকিল বর বা কনের পক্ষ থেকে দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম সাক্ষ্যের সামনে বর বা কনেকে প্রস্তাব পেশ করেন সরাসরি।আর দুইজন স্বাক্ষ্য উক্ত প্রস্তাবটি ও তা গ্রহণ করার বিষয়টি সামনে থেকে স্বকর্ণে শ্রবণ করে বিবাহ সম্পন্ন করা। উপরোক্ত দুই সূরতের মাঝে প্রথম সূরতে বিবাহ হয় না। কিন্তু দ্বিতীয় সূরতে বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। উক্ত ব্যক্তির বিবাহটি হয়েছে কি না? তা উপরোক্ত দুই পদ্ধতির বিবরণ দ্বারা আপনি নিজেই নির্ধারিত করে নিতে পারবেন। فى الدر المختار- (و) شرط (حضور) شاهدين (حرين) أو حر وحرتين (مكلفين سامعين قولهما معا) (الدر المختار ، كتاب النكاح،-3/9) অনুবাদ-বিবাহ সহীহ হওয়ার শর্ত হল শরীয়তের মুকাল্লাফ (যাদের উপর শরীয়তের বিধান আরোপিত হয়) এমন দুইজন আযাদ পুরুষ সাক্ষি বা একজন আযাদ পুরুষ ও দুইজন মহিলা সাক্ষি হতে হবে, যারা প্রস্তাবনা ও কবুল বলার উভয় বক্তব্য স্বকর্ণে উপস্থিত থেকে শুনতে পায়। -আদ দুররুল মুখতার-৩/৯, ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-১/২৬৮

২ নং এর জবাব আসলে এসবই অজুহাত। বিয়ের আগে কেন এসব দেখা হয়নি? এখন মেয়ের মাথায় চুল নেই, মেয়ে পক্ষ নিম্নমানের এসব বিষয় আগে কোথায় ছিল? বিয়ের পর এসব বের করে কেন একটি মেয়েকে হেনস্থা করা হবে? কোন বিয়েই ভেঙ্গে যাক এটি কিছুতেই ইসলাম সমর্থন করে না। তবে যদি কোন দ্বীনী বিষয় হতো, তাহলে ভিন্ন কথা। শারিরীক সমস্যা কারো ব্যক্তিগত দোষ নয়। এটি আল্লাহ তাআলার দেয়া। এটি কারোর এখতিয়ারী বস্তু নয়। যদি এসব অনর্থক অজুহাতে একটি মেয়েকে তাড়িয়ে দেয়া, হয়তোবা এর চেয়ে বড় কোন বিপদে বা সমস্যা উক্ত পরিবারকে আল্লাহ তাআলা ফেলে দিতে পারেন। তাই চিন্তা ভাবনা করে, আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়ে বিষয়গুলো বিবেচনা করার অনুরোধ থাকবে। ছেলের স্ত্রীকে বউ হিসেবে নয় মেয়ে হিসেবে দেখার অনুরোধ থাকবে শ্বাশুরী এবং শ্বশুরের প্রতি।

৩ নং এর জবাব এসব ঠুনকো অজুহাতে স্ত্রীকে তালাক দেয়া ইসলাম সমর্থন করে না। তবে যদি তালাক দেয়, তাহলে তালাক পতিত হয়ে যাবে।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً، إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ

হযরত আবূ হুরায়রা e থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেছেন, কোন মুমিন পুরুষ যেন কোন মুমিন নারীকে শত্রু মনে না করে। কেননা, যদি সে তার এক কাজকে নাপছন্দ করে, তার অপর কাজকে পছন্দ করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৪৬৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৩৬৩

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّ مِنْ أَكْمَلِ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا، أَحْسَنَهُمْ خُلُقًا، وَأَلْطَفَهُمْ بِأَهْلِهِ

হযরত আয়শা e থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেছেন, মুমিনদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিকতর পূর্ণ মুমিন, যে ব্যক্তি সদাচারী এবং নিজ পরিবারের জন্য কোমল এবং অনুগ্রহশীল। -সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৬১২, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৪২০৪

৪ নং প্রশ্নের জবাব স্ত্রীকে তালাক দেবার জন্য শারিরীক সম্পর্ক করা জরুরী নয়। তাই উক্ত মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে রাখার ইচ্ছে না থাকলে তালাক দিতে পারবে। এ ক্ষমতা স্বামীর রয়েছে। আর এক্ষেত্রে যদি বিয়ের সময় মোহর নির্দিষ্ট করা থাকে, তাহলে নির্ধারিত মোহরের অর্ধেক উক্ত মেয়েকে প্রদান করা আবশ্যক। আর যদি মোহর নির্দিষ্ট না করেই বিবাহ করে থাকে, তাহলে এক জোড়া কাপড় তথা জামা, পায়জামা ও উড়না প্রদান করা আবশ্যক। আর যদি স্ত্রী সেচ্ছায় তার মোহরের অধিকার ছেড়ে দেয়, তাহলে মোহর মাফ বলে গণ্য হবে। মোহর দিতে হবে না। আর যদি মাফ না করে, তাহলে দিতে হবে।

وَإِن طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِن قَبْلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ وَقَدْ فَرَضْتُمْ لَهُنَّ فَرِيضَةً فَنِصْفُ مَا فَرَضْتُمْ إِلَّا أَن يَعْفُونَ أَوْ يَعْفُوَ الَّذِي بِيَدِهِ عُقْدَةُ النِّكَاحِ ۚ وَأَن تَعْفُوا أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۚ وَلَا تَنسَوُا الْفَضْلَ بَيْنَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (٢:٢٣٧) আর যদি মোহর সাব্যস্ত করার পর স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তাহলে যে, মোহর সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে। অবশ্য যদি নারীরা ক্ষমা করে দেয় কিংবা বিয়ের বন্ধন যার অধিকারে সে (অর্থাৎ, স্বামী) যদি ক্ষমা করে দেয় তবে তা স্বতন্ত্র কথা। আর তোমরা পুরুষরা যদি ক্ষমা কর, তবে তা হবে পরহেযগারীর নিকটবর্তী। আর পারস্পরিক সহানুভূতির কথা বিস্মৃত হয়ো না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সেসবই অত্যন্ত ভাল করে দেখেন। -সূরা বাকারা-২৩৭ لَّا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِن طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ مَا لَمْ تَمَسُّوهُنَّ أَوْ تَفْرِضُوا لَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى الْمُوسِعِ قَدَرُهُ وَعَلَى الْمُقْتِرِ قَدَرُهُ مَتَاعًا بِالْمَعْرُوفِ ۖ حَقًّا عَلَى الْمُحْسِنِينَ (٢:٢٣٦)

স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার আগে এবং কোন মোহর সাব্যস্ত করার পূর্বেও যদি তালাক দিয়ে দাও, তবে তাতেও তোমাদের কোন পাপ নেই। তবে তাদেরকে কিছু খরচ দেবে। আর সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং কম সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সাধ্য অনুযায়ী। যে খরচ প্রচলিত রয়েছে তা সৎকর্মশীলদের উপর দায়িত্ব। -সূরা বাকারা-২৩৬

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২৭ নভেম্বর, ২৩