শ্বশুর কর্তৃক পুত্রবধু ধর্ষিতা হলে হুকুম কি

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসবিবাহ-তালাক১৭ মে, ২১

প্রশ্ন

শশুর কর্তৃক পুত্র বধু ধর্ষিতা হলে। এই স্ত্রী, তার স্বামীর জন্য অর্থাৎ ধর্ষণকারির ছেলের জন্য বৈধ অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে দলিল ভিত্তিক চার মাজহাবের চার ইমামের মতামত কি?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

পাপিষ্ঠ পিতার এ ঘৃণ্য কর্ম দ্বারা ছেলের জন্য স্বীয় স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে কি না? এ বিষয়ে চার ইমামের মাঝে দু’টি মত রয়েছে। যথা-

১. ইমাম আবূ আজম আবূ হানীফা i এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল i এর মতে ধর্ষণ করার দ্বারা ছেলের জন্য উক্ত স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে। ইমাম মালেক i এর একটি কওলও এটি। তবে মালেকী মাযহাবের বিশুদ্ধ কওল দ্বিতীয়টি।

২. ইমাম শাফেয়ী i এবং ইমাম মালিক i এর মতে ছেলের জন্য স্ত্রী হারাম হবে না। -কিতাবুল ফিক্বহ আলালমাযাহিবিল আরবাআ-৪/৬২-৬৫

الحنفية: وأما الذى يوجب حرمة المصاهرة فهو اربعة أمور، أحدهما العقد الصحيح، ثانيها: الوطء سواء كان بعقد صحيح أو فاسد، أو زنا، ثالثها المس، رابعها: نظر الرجل الى داخل فرج المرأة، ونظر المرأة إلى ذكر الرجل، الشافعية: أم الزنا فإنها لا يوجب حرمة المصاهرة على أى حال، لأنها نعمة من الله لا يصح زوالها بذلك الفعل المحرم، وكما لا يحرم الزنا لا يحرم المس ولا النظر بشهوة على أى حال، المالكية: أم الزنا فأن المعتمد أنه لا ينشر الحرمة، فمن زنى بامرأة فإن له أن يتزوج بأصولها وفروعها ولأبيه وابنه أن يتزوجها، الحنابلة: أما وطء الشبهة والزنا فإنه تثبت به حرمة المصاهرة على الصحيح من المذهب، فمن زنى بإمرأة حرمت عليه أمها وبنتها وحرمت على أبيه وابنه (كتاب الفقه على المذاهب الأربعة، كتاب النكاح، مبحث فيما تثبت به حرمة المصاهرة-٦١-٦٦)

জিনা করার দ্বারা হুরমাতে মুসাহারাত তথা সুনির্দিষ্ট কিছু আত্মীয়কে আজীবন বিবাহ নিষিদ্ধতার বিধান আরোপিত হয় কি না? ব্যাখ্যা করলে এমন দাঁড়ায়, যেমন আব্দুল আলীম এক মহিলাকে বিবাহ করল, এখন আব্দুল আলীমের জন্য তার স্ত্রীর মাকে বিবাহ করা হারাম। সেই সাথে তার স্ত্রীর আগের ঘরের মেয়ে এবং তার নিচের কাউকে বিবাহ করা হারাম। সেই সাথে আব্দুল আলীমের আগে ঘরের ছেলের জন্য আব্দুল আলীমের নতুন স্ত্রীকে বিবাহ করা হারাম। আব্দুল আলীম বিবাহ না করে কোন মহিলার সাথে (নাউজুবিল্লাহ) জিনা করলেও কি এরকম হুরমতে মুসাহারাত এর হুকুম আরোপিত হবে কি না? এ বিষয়ে চার ইমামের মাঝে মতভেদ আছে। তবে দলীলের দিক থেকে শক্তিশালী বক্তব্যটি ইমাম আবু হানীফা i এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল i এর।

তথা বিয়ের দ্বারা যেমন হুরমাতে মুসাহারত সাব্যস্ত হয়, তেমনি জিনার দ্বারাও হুরমাতে মুসাহারাত সাব্যস্ত হয়। কয়েকটি প্রমাণ নিচে উপস্থাপন করা হল। কুরআন থেকে وَلاَ تَنكِحُواْ مَا نَكَحَ آبَاؤُكُم مِّنَ النِّسَاء إِلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاء سَبِيلاً • যে নারীকে তোমাদের পিতা-পিতামহ বিবাহ করেছে তোমরা তাদের বিবাহ করো না। কিন্তু যা বিগত হয়ে গেছে। এটা অশ্লীল, গযবের কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ। -সূরা নিসা-২২

নিকা তথা বিয়ের অর্থ দু’টি। যথা-

১. আকদ করা।

২. সহবাস করা।

আসলে মৌলিক অর্থ সহবাসই। কিন্তু যেহেতু আকদের মাধ্যমেই সহবাস জায়েজ হয়, তাই নিকাহ বলে আকদকেই সাধারণত বুঝানো হয়ে থাকে। ইমাম রাজী i উক্ত আয়াতের অধীনে বিধান লিখতে গিয়ে লিখেন- قَوْله تَعَالَى وَلا تَنْكِحُوا مَا نَكَحَ آباؤُكُمْ مِنَ النِّساءِ قَدْ أَوْجَبَ تَحْرِيمَ نِكَاحِ امْرَأَةٍ قَدْ وَطِئَهَا أَبُوهُ بِزِنًا أَوْ غَيْرِهِ إذْ كَانَ الِاسْمُ يَتَنَاوَلُهُ حَقِيقَةً فَوَجَبَ حَمْلُهُ عَلَيْهَا • আল্লাহ তাআলার বাণী “যে নারীকে তোমাদের পিতা-পিতামহ বিবাহ করেছে তোমরা তাদের বিবাহ করো না” আবশ্যক করছে ঐ মহিলাকে বিবাহ করা, যার সাথে তার পিতা সহবাস করেছে জিনার মাধ্যমে বা অন্যকোনভাবে। যেহেতু নিকাহ শব্দটির আসল অর্থ সহবাস। তাই আসল অর্থে এটিকে নিহিত করাই আবশ্যক। -আহকামুল কুরআন লিররাজী-২/১৩৬; সূরা নিসা-২২

সাহাবায়ে কেরামের ফাতওয়ার আলোকে নিচে উদ্ধৃত সাহাবায়ে কেরাম জিনাকে হুরমাতে মুসাহারাত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যেমন-

১. হযরত ইমরান বিন হুসাইন e -আহকামুল কুরআন লিররাজী-২/১৩৭

২. হযরত উবাই বিন কা’ব e -ইলাউস সুনান-১১/২০

৩. হযরত উমর e

৪. হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e

৫. হযরত ইবনে আব্বাস e । (সহীহ কওল অনুপাতে)

৬. জাবের বিন আব্দুল্লাহ e

৭. হযরত আয়শা e । (ফাতহুল কাদীর লিইবনে হুমাম) তাবেয়ীগণের ফাতওয়া নিচে উদ্ধৃত তাবেয়ীগণও একই ফাতওয়া প্রদান করতেন। যেমন-

১. হযরত হাসান বসরী i

২. হযরত কাতাদা বিন দাআমা i

৩. সাঈদ বিন মুসাইয়িব i

৪. সুলাইমান বিন ইয়াসার i

৫. সালেম বিন আব্দুল্লাহ i

৬. মুজাহিদ i

৭. আতা i

৮. ইবরাহীম নাখয়ী i

৯. আমের i

১০. হাম্মাদ i

এছাড়াও রয়েছেন ইমাম মুহাম্মদ i , ইমাম আবু ইউসুফ i , ইমাম যুফার i , ইমাম সুফিয়ান বিন সাঈদ সওরী i , ইমাম আওযায়ী i , জাবের বিন জায়েদ i , তাউস i , ইমাম ইসহাক i প্রমূখ মুহাদ্দিস ও ফক্বহগণ। (আহকামুল কুরআন লিলজাসসাস, উমদাতুল কারী, ফাতহুল কাদীর) যুক্তির নিরিখে হুরমাতে মুসাহারাতের মূল কারণ হল সহবাসকারীর অংশ হওয়া। যার সাথে সহবাস করা হয়, তার মাঝে সহবাসকারীর একটি অংশ থাকে। পিতা যদি কারো সাথে সহবাস করে, তাহলে উক্ত মহিলার মাঝে পিতার একটি অংশ চলে যায়, আর সন্তানও পিতার একটি অংশ। আর এক অংশ অন্য অংশকে বিবাহ করতে পারে না। এ কারণে পিতা যার সাথে সহবাস করবে, সন্তানের জন্য উক্ত মহিলা হারাম হয়ে যাবে।

তাহলে বুঝা গেল, হুরমাতের মূল কারণ হল অংশ হওয়া তথা বাচ্চা হওয়া। আর যেহেতু বাচ্চা হওয়াটি দেখা যায় না, এটি লুকায়িত বিষয়। তাই হুরমাতে মুসাহারাতের বাহ্যিক কারণ ধরা হয় বিবাহকে। তথা বিয়ের মাধ্যমে হুরমাতে মুসাহারাত সাব্যস্ত হয়ে যায়। আর একথাতো পরিস্কার যে, বাচ্চা হওয়া হুরমতে মুসাহারাতের মূল কারণ হলেও তা লুকায়িত থাকায় বিয়েকে রাখা হয়েছে তার বাহ্যিক কারণ। তাহলে বিবাহ ছাড়াই যদি বাচ্চা হওয়ার কারণ পাওয়া যায়, তাহলে কেন হুরমাতে মুসাহারাত সাব্যস্ত হবে না? যেখানে দূরবর্তী কারণ বিবাহকে হুরমাতে মুসাহারাতের কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে, সেখানে নিশ্চিত ও মূল কারণ পাওয়া যাওয়া সত্বেও হুরমাত সাব্যস্ত না করার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে? এ কারণেই যেহেতু পিতা ছেলের স্ত্রীর সাথে জিনা করেছে, এ কারণে উক্ত স্ত্রী ছেলের জন্য হারাম হয়ে গেছে।

শেষ কথা, আখেরাতের জীবনই অনন্ত জীবন। সেটিই আসল জীবন। তাই ৭০/৮০ বছরের অল্প ক’দিনের জীবনের টানে আখেরাতের অনন্ত জীবন বরবাদ করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই যে পরিবারেই এ জঘন্য কাজটি সম্পাদিত হয়েছে উক্ত ছেলে যেন স্বীয় স্ত্রী থেকে পৃথক হয়ে যায়। আর ইসলামী খেলাফত থাকলে উক্ত পাপিষ্ঠ নির্লজ্জ পিতাকে প্রকাশ্যে প্রস্তারাঘাত করে হত্যা করা হতো। এরকম জঘন্য কর্ম কোন মনুষত্বের কাজ নয়। পাপিষ্ঠ পিতাকে আল্লাহ তাআলার কাছে কায়মানোবাক্যে তওবা করার জন্য বলতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তার বিধান অনুপাতে জীবন যাপিত করার তৌফিক দান করুন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৭ মে, ২১