রোযা ও তারাবীহের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ

ইসলামী জিন্দেগীরোজা১৯ ফেব, ২১

প্রশ্ন

হাদীসে এসেছে, “অনেক রোযাদারের রোযা রাখার বিনিময় ক্ষুধার্ত থাকা ছাড়া আর কিছুই হাসিল হবে না। তেমনিভাবে অনেকের রাত্র জাগরণ ও তারাবীহর নামায পড়ার বিনিময় জাগ্রত থাকা ছাড়া আর কিছুই হাসিল হবে না”। এ হাদীসের ব্যাখ্যা কি? আমাদের দেশে তারাবীহের নামাযে যেভাবে দ্রুত কুরআন পাঠ করা হয়, যার কারণে আয়াতের শেষ অংশ ছাড়া আর কোন অংশ পরিষ্কার বুঝার কোন উপায় থাকে না, এটা কতটুকু ঠিক?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

উক্ত হাদীসের উদ্দেশ্য ও মর্ম হলো- যারা রোযা রেখে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসূহকে গুনাহ থেকে হিফাজত করে না, রামাযানের পূর্বে যেমন গুনাহে লিপ্ত ছিল, রামাযানেও তেমনি গুনাহে লিপ্ত থাকে। হালাল রিযিকের ব্যবস্থা করে না, জিহ্বা ও চক্ষুর হিফাজত করে না (অথচ রোযার মূল উদ্দেশ্য গুনাহ ছেড়ে দিয়ে তাকওয়া অর্জন করা।) এমন ব্যক্তিদের রোযার দ্বারা যদিও কানুন মাফিক তাদের জিম্মাদারী আদায় হয়, কিন্তু রোযার আসল উদ্দেশ্য ও রুহানিয়্যাত হাসিল না হওয়ায় তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, ক্ষুধার্ত থাকা ছাড়া তাদের রোযার অন্য কোন বিনিময় হাসিল হয় না।

তেমনিভাবে যারা রামাযানে কষ্ট করে ২০ রাকাত তারাবীহ পড়লো, কিন্তু সে নামাযে মনোনিবেশ করলো না বা নামাযে এমন দ্রুত কুরআন শরীফ পড়লো যে, হরফগুলো সঠিকভাবে মাখরাজ থেকে সিফাতের সাথে উচ্চারিত হতে পারে না, মদ-গুন্নাহ ইত্যাদি সঠিকভাবে আদায় হয় না, ওয়াকফ লাযিমের প্রতি লক্ষ্য করা হয় না, এ সমস্ত লোক হাদীসের দ্বিতীয় অংশের দ্বারা উদ্দেশ্য। এভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা জায়িয নয়, তেমনিভাবে এরুপ কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা এবং এরূপ তিলাওয়াতের সম্মতি দেয়াও জায়িয নয়। কুরআনে কারীমকে তাজবীদের সাথে সহীহভাবে তিলাওয়াত করা জরুরী । আর সহীহভাবে তিলাওয়াতের ভিত্তিতে সাওয়াবের ওয়াদা করা হয়েছে। অশুদ্ধ তিলাওয়াতকারীর জন্য কুরআন লানত করতে থাকে। তবে ফরয নামায থেকে তারবাহী নামাযে একটু চালু করে পড়ার নিয়ম রয়েছে। এরুপ পদ্ধতিতে কুরআন তিলাওয়াত করাকে হদর বলা হয়। হদর এর নিয়ম মত সহীহ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করায় কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেভাবে তারাবীহ নামায পড়া হয় সেটাকে কোনক্রমেই হদর পড়া বলা চলে না। সুতরাং এ ধরনের তিলাওয়াত দ্বারা সাওয়াবের কোন আশা করা যায় না। আর বর্তমানে যেভাবে দ্রুত পড়া এবং কম সময়ে তারাবীহ খতম করার প্রশংসা করা হয় এটা নিতান্তই অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ যারা সঠিক নিয়মে সহীহভাবে তারাবীহ পড়ে থাকেন তাদের নামায দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত কারীদের থেকে মাত্র ১০/১৫ মিনিট সময় বেশী লাগে। এ ১০/১৫ মিনিটের জন্য তারাবীহ নামাযের সাওয়াব বাতিল করে গুনাহগার হওয়া কত বড় দুর্ভাগ্যের কথা। এজন্য পূর্বেই হাফেয সাহেবদের সাথে এ মর্মে শর্ত করা জরুরী, যাতে করে তারা এভাবে কুরআন কারীমকে বিগড়িয়ে সকলকে গুনাহগার না করেন। বরং সহীহভাবে হদরের নিয়মে কুরআন তিলাওয়াত করেন।

আরো একটি কারণে তারাবীহ নামাযের সাওয়াব বাতিল হয়ে রাত জাগরণ ছাড়া আর কোন ফায়েদা হয় না। সেটা হল হাফেযদেরকে চুক্তির ভিত্তিতে বা চুক্তি ছাড়া প্রথা অনুযায়ী তারাবীহ নামাযের বিনিময় প্রদান করা। এটা শরীয়তে সম্পূর্ণ নিষেধ।

তারাবীহ নামায সুন্নাত। তারাবীহ নামাযে কুরআন শরীফ খতম করাও সুন্নাত। কিন্তু বিনিময় লেনদেন করা হারাম। আর এটা সহজে অনুমেয় যে, সুন্নাত আদায় করার জন্য হারাম কাজের অনুমতি হতে পারে না। এজন্য ফুকাহায়ে কিরাম লিখেছেন, “কুরআন খতমের বিনিময় গ্রহণ করে না এ ধরনের মুখলিস হাফেয না পাওয়া গেলে নির্ধারিত ইমামের পিছনে বিনিময় ছাড়া সূরা তারাবীহ পড়ে নিবে। এটাই উত্তম। কারণ, এক্ষেত্রে খতমের সাওয়াব না হলেও অন্তত তারাবীহ নামাযের সাওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু বিনিময় দিয়ে খতম তারাবীহ পড়লে তো খতম ও তারাবীহ উভয়টির সাওয়াবই বাতিল হয়ে গেল। বিষয়টির প্রতি সকলেরই দৃষ্টি দেয়া উচিত।

অনেকে প্রশ্ন করেন যে, হাফেয সাহেবদের সংসার আছে, বিনিময় দেয়া জায়িয না হলে তাঁরা চলবেন কিভাবে? তাদের কাছে জিজ্ঞাসা- তাহলে কি তারা হাফেযদেরকে হারাম খাওয়ায়ে চালাতে চান? অথচ তারা তাদেরকে ইমামতির সর্বোচ্চ পদে বসিয়েছেন। লক্ষ্য করুন! যে রাব্বুল আলামীনের শরীয়তে তারাবীহ নামায বিনিময় নেয়া হারাম ঘোষিত হয়েছে, তিনিই সকলের রিযিকের দায়িত্ব নিজের উপর রেখেছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের মাথা ব্যথার কিছুই নেই। তিনিই হাফেযদেরক কুরআনে পাক হিফয করার তৌফিক দান করেছেন। নতুবা কোন ব্যক্তি এত বড় কিতাব মুখস্থ রাখতে পারতেন না এবং তিনিই বিধান জারী করেছেন যে, হাফেযগণ আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলার বান্দাদেরকে কুরআন শুনাবেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য সম্মানজনক রিযিকের ব্যবস্থা করবেন। কিভাবে কোথেকে করবেন তিনিই ভাল জানেন। বর্তমান যামানায় যে সমস্ত হাফেযগণ হারাম পয়সা তরক করেছেন, আল্লাহ তা‘আলার তাদের জন্য ইজ্জতের সাথে রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন।

উল্লেখ্য, কোন হাফেজ সাহেব যদি আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে তারাবীহ পড়ান এবং বিনিময় না নেয়ার ঘোষণা করেছেন অপর দিকে মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও হাফেয সাহেবকে বিনিময় না দেয়ার ঘোষণা করেছেন। অতঃপর মুসল্লগীণ নিজস্ব উদ্যোগে হাফেয সাহেবের মুহাব্বতে খতমের সময় ব্যতীত অন্য সময় কিছু হাদিয়া প্রদান করে তবে সেটাকে কুরআন খতমের বিনিময় বলা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে মসজিদ হাফেযদের নামে খাতা কলম নিয়ে যেভাবে চাঁদা আদায় করে তাদেরকে দেয়া হয়, তা শরীয়তের বর্ণিত হাদীয়ার আওতায় পড়ে না। তেমনিভাবে মসজিদ ফাণ্ড থেকে হাফেয সাহেবদেরকে যে বিনিময় দেয়া হয় তা-ও উক্ত হাদিয়ার আওতায় পড়ে না। তাছাড়া এভাবে চাঁদা তুললে প্রকারান্তে হাফিযদের ভিক্ষুক বানিয়ে বেইয্যত করা হয়।

- والله اعلم باالصواب -

সূত্র

  • ফাতাওয়া শামী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৯৩
  • আবূ দাঊদ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২২০
  • ফাতাওয়া শামী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৫৭
  • আহসানুল ফাতাওয়া, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৫১৪
  • মুসনাদে আহমদ, পৃষ্ঠা: ৩৫৭
  • ইমদাদুল মুফতীন, পৃষ্ঠা: ৩৬৫
  • তাফসীর মাজহারী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩৬
  • তিরমিযী শরীফ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৫৫
  • মিশকাত, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১১৪
  • তিরমিযী শরীফ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১১৯
  • নাসায়ী শরীফ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১১৬
  • সূরা: বাকারা, আয়াত: ৪১
  • সূরা: মুযযাম্মিল, আয়াত:

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৯ ফেব, ২১