মুসাফাহা কয় হাতে করবে এক হাতে না দুই হাতে

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসসভ্যতা ও সংস্কৃতি১০ এপ্রিল, ২১

প্রশ্ন

মুসাফাহা কি দুই হাত দিয়ে করতে হয় নাকি এক হাত দিয়ে? আহলে হাদিসরা বলেন যে এক হাতে মুসাফাহা করা সুন্নত। এটা কি সঠিক?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

এক হাতে মুসাফাহা করার সূচনা যখন দুই জন মুসলমান পরস্পর সাক্ষাৎ হয়, তখন সালাম দেয়, যা ছিল পরস্পর মোহাব্বত ভালবাসার নিদর্শন। সালামের পর মুসাফাহাও করে। আর মুসলমানদের মাঝে উভয় হাতে মুসাফাহা করার পদ্ধতি ছিল নিরবচ্ছিন্ন আমল পরম্পরায় স্বীকৃত।

ইংরেজদের আমলের পূর্বে কোন ইসলামী গ্রন্থে দুই হাতে মুসাফাহা করাকে বেদআত ও সুন্নাতের খেলাফ বলে মন্তব্য করা হয়নি। ইংরেজদের আমলে শুরু হয় এ আশ্চর্য পরিবেশ। মুসলমানরা পরস্পর সাক্ষাতের সময় করে দুহাতে মুসাফাহা। আর ইংরেজরা পরস্পর সাক্ষাতের সময় করে এক হাতে মুসাফাহা।

ইংরেজদের এ প্রথাকে সর্ব প্রথম গ্রহণ করে আধুনিক শিক্ষতরা। কলেজ ভার্সিটিতে এক হাতে মুসাফাফা করার রেওয়াজ শুরু করে দেয়। অবশ্য তারা এটাকে ইংরেজদের পদ্ধতিই মনে করত। কিন্তু পরবর্তীতে সেসব আধুনিক শিক্ষিতদের তাকলীদ করে কথিত আহলে হাদীসরাও শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করার রীতি বের করে। কিন্তু পার্থক্য হল কথিত আহলে হাদীসরা ইংরেজদের পদ্ধতিটিকে সুন্নাত সাব্যস্ত করে মুসলমানদের মাঝে নিরবচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় চলে আসা দুই হাতে মুসাফাহার আমলী পদ্ধতিকে বেদআত ও খেলাফে সুন্নাত বলে প্রচারণা শুরু করে দেয়।

ইংরেজদের পদ্ধতিটিকে জিন্দা করার জন্য শহীদ হয়ে যাওয়ার অঙ্গিকারও ব্যক্ত করে। সেই সাথে রাসূল c এর সুন্নাতের অনুসারী জামাতকে রাসূল c এর সুন্নাতের বিরোধী, সুন্নাত ধ্বংসকারী হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে। মুসলমানদের কাছে প্রচলিত ইসলামী পদ্ধতিকে মিটিয়ে দেয়াকে সুন্নাত জিন্দা করা নামে অভিহিত করতে থাকে।

এভাবেই সালাম ও মুসাফাহা, যেটা আজ পর্যন্ত মুসলমানদের পরস্পর মুহাব্বত ও মাগফিরাতের মাধ্যম ছিল, সেটা হয়ে গেল বিবাদ-ঝগড়া ও বিভক্তির মাধ্যম। সে সময়তো কোন ইসলামী খিলাফত ছিল না, যারা মুসলমানদের মাঝে বিভক্তির এ ভয়াবহ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করবে। বরং ছিল ইংরেজ শাসন। যাদের পলিসিই ছিল- “বিবাদ লাগাও ও শাসন কর”। এ কারণেই তারা ছিল সরকারী আনূকুল্যে। সরকারী সুযোগ সুবিধায় তাদের ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে এ আহলে হাদীস দলটি।

এক হাতে মুসাফাহা করার দলিলসমূহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে তাদের প্রশ্ন করা হয় যে, আপনারা যে শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করাকে সুন্নাত এবং বাম হাত লাগানোকে বেদআত ও খেলাফে সুন্নাত সাব্যস্ত করছেন, আপনাদের এ বক্তব্যের পক্ষে কি রাসূল c এর কোন কওলী হাদীস আছে? যাতে রাসূল c বলেছেন যে, যেমন শুধু ডান হাতে খানা খাওয়ার হুকুম তেমনি শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করার হুকুম। যেমন ইস্তিঞ্জা করার সময় ডান হাত লাগানোকে নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি মুসাফাহা করার সময় বাম হাত লাগানোকেও নিষেধ করা হয়েছে? এমন কোন হাদীস থাকলে বুখারী, মুসলিম থেকে পেশ করুন। এতে না থাকলে সুনানে আরবাআ থেকে পেশ করুন। যদি সুনানে আরবাআতে না পাওয়া যায়, তাহলে অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ থেকে পেশ করুন। যদি এ হুকুম সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত না হয়, তাহলে “শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করার সহীহ সরীহ হাদীস আপনাদের কাছে নেই” এ স্বীকারোক্তি করার পর হাসান পর্যায়ের হাদীস উপস্থাপন করুন। যদি হাসান হাদীসও না পাওয়া যায়, তাহলে এ হুকুমটি কোন দুর্বল হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত করুন।

কিন্তু নামধারী আহলে হাদীসরা এ ধরণের হাদীস উপস্থাপন করতে আজ পর্যন্ত ব্যর্থ ছিল, ইনশাআল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত ব্যর্থই থাকবে। যখন কথিত আহলে হাদীসরা শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করার বর্ণনা কওলী হাদীস দ্বারা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের বলা হল, রাসূল c থেকে কোন কওলী সহীহ হাদীস যাতে রাসূল c ডান হাতে মুসাফাহা করতেন, আর বাম হাত আলাদা রাখতেন মর্মে পেশ করুন। যদি সহীহ পাওয়া না যায়, তাহলে হাসান হাদীস, যদি হাসান হাদীস না পাওয়া যায়, তাহলে দুর্বল হাদীস উপস্থাপন করুন। কিন্তু তারা এটা করতেও অপারগ ছিল। অপারগ থাকবেও।

অবশেষে তাদের কাছে তাক্বরীরী হাদীস থাকলে উপস্থাপন করতে বলা হল। যাতে থাকবে যে, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল c এর সামনে শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করতেন, আর রাসূল c তা দেখে চুপ করে থাকতেন। যদি এর সহীহ বা হাসান হাদীস না পাওয়া যায়, তাহলে দুর্বল হলেও উপস্থাপন করতে বলা হল। কিন্তু তারা এটা উপস্থাপন করতেও অপারগতা প্রকাশ করল। এখনো অপারগ, ইনশাআল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত অপারগই থাকবে।

আহলে সুন্নাতের অনুসারীরা তাদের বললেন-যেখানে শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করার কোন হাদীসই নেই, সেখানে এটিকে সুন্নাত কিভাবে বলা হয়? অথচ, কখনো কখনো হাদীস দ্বারা কোন বিষয় প্রমাণিত হলেও তা সুন্নাত হয় না। যেমন- এক কাপড়ে নামায পড়া, জুতা পরিধান করে নামায পড়া, বাচ্চাকে কাঁধে উঠিয়ে নামায পড়াতো মুত্তাফাক আলাই বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু এর কোনটিইতো সুন্নাত নয়। কেননা, সুন্নাত প্রমাণের জন্য ধারাবাহিকভাবে করা শর্ত। যা এখানে পাওয়া যায়নি। তাহলে শুধু ডান হাতে মুসাফাহা করার কোন বর্ণনাতো হাদীসে নেইই, সেখানে ধারাবাহিকভাবে করা কোথায় পাওয়া যাবে? তাই এটাকে সুন্নাত বলাটা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। দলিল পাওয়া গেছে!?

অবশেষে যখন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যে, মুসলমানদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা আমলকে বেদআত বলে, ইংরেজ ও ইংরেজী শিক্ষিতদের পদ্ধতিকে নবীজী c এর তরীকা কেন বলা হচ্ছে? একথা শুনে বিড়াল থলে থেকে বেড়িয়ে এল। বলতে লাগল- “সালামের কিছু হাদীসের মাঝে اخذ باليد، اخذ بيده • তথা হাত ধরেছেন, ইত্যাদী শব্দ এসেছে। আর يد শব্দটি এক বচন। যার দ্বারা বুঝা যায় যে, এক হাতেই মুসাফাহা করা উচিত।

আহলে সুন্নাতের অনুসারীরা তাদের এ বক্তব্য শুনে হাদীস সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা দেখে অবাক হয়ে যান। কারণ মানুষের শরীরে যেখানে এক ধরণের অঙ্গ একাধিক হয়, সেখানে এক ধরণের হওয়ার কারণে এক বচনের শব্দ ব্যবহৃত হয় প্রত্যেক ভাষায়ই। যেমন বলা হয় যে, “আমি আপনাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে স্বচক্ষে দেখেছি”। একথার দ্বারা কি কোন বেওকুফ একথা বুঝবে যে, লোকটি কানা তাই এখানে এক বচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে? কখনো বলা হয় যে, “আমি নিজের কানে তোমার কথা শুনেছি”। এর মানে কি লোকটি কথা শুনার সময় অন্য কানটি বন্ধ করে রেখেছিল? তাছাড়া এক ব্যক্তিকে অন্যকে বলে থাকে যে, “আমি আমার পা সেখানে রাখবো না”। এর মানে কি এটা যায় যে, লোকটি পা একটিই? আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন- وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَىٰ عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا • (কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরূ তোমাকে নিন্দাযোগ্য ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হয়। -সূরা ইসরা-২৯ এ আয়াতে কি এক হাতই উদ্দেশ্য? আর সে হাত ডান হাত?!

রাসূল c নিজেও দুআ করতেন, আর অন্যদেরও শিখাতেন যে, اللهم اجعل فى بصرى نورا واجعل فى سمعى نورا • তথা হে আল্লাহ! আমার চোখে নূর দাও! আমার কানে নূর দাও! -সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৩৫ তাহলে এ হাদীসে بصر سمع এক বচনের সীগা ব্যবহৃত হওয়ার কারণে এক কান ও এক চোখ বুঝানো উদ্দেশ্য? আর المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده • প্রকৃত মুসলমান ঐ ব্যক্তি, যার হাতও মুখ হতে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১০ এবং من رأى منكم منكرا فليغيره بيده • যে ব্যক্তি কোন নিষিদ্ধ কাজ দেখে তাহলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৬

এসব হাদীসে يد এক বচন আসায় কি এক হাতই উদ্দেশ্য? এক্ষেত্রেও অন্য হাত ব্যবহার করা সুন্নাতের খেলাফ হবে? এসব হাদীসে يد দ্বারা উদ্দেশ্য যদি হাতের দ্বারা উভয় হাতই উদ্দেশ্য ধরা না হয় তর্কের খাতিরে, বরং এক হাত উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তাহলে আরবীতে يد শব্দতো আঙ্গুল থেকে নিয়ে কাঁধ পর্যন্ত পূর্ণ অংশকেই বুঝায়। এ অর্থ হিসেবে কি দুই ব্যক্তি যদি উভয়ে কনিষ্ঠা আঙ্গুলি মিলায়, বা উভয়ের বাম কাঁধ পরস্পর মিলায়, তাহলে এ হাদীসের উপর আমল হবে? না হবে না? কেননা বাম হাতও তো يد পা তো নয়! যদি একথা মেনেও নেয়া হয় যে, এখানে يد দ্বারা এক হাতই উদ্দেশ্য, তবুও উম্মতের নিরবচ্ছিন্ন আমলকে বেদআত ও খেলাফ কিভাবে বলা যায়?

দেখুন! রাসূল c থেকে এক কাপড়ে নামায আদায় করা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু উম্মতের নিরবচ্ছিন্ন আমল হল তিন কাপড়ে নামায পড়া। উম্মতের এ নিরবচ্ছিন্ন আমলের মাঝে রাসূল c এর এক কাপড়ে নামায পড়ার হাদীসের উপরও আমল হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে অন্য হাদীসের উপরও। আজ পর্যন্ত উম্মতের এ নিরবচ্ছিন্ন আমলকে কেউ খেলাফে সুন্নাত বলে মন্তব্য করেনি। ঠিক তেমনিভাবে উম্মতের মাঝে দুই হাতে মুসাফাহা করার যে নিরবচ্ছিন্ন আমল চলে আসছে, তাতে এক হাতে মুসাফাহা করার হাদীসের উপরও আমল হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে দুই হাতে মুসাফাহা করার হাদীসের উপরও আমল হয়ে যাচ্ছে।

তাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কোন হাদীসের বিরোধীতা করার ভয় নেই। যেমন হাদীসের মাঝে এক এক বার অঙ্গ ধোয়ার হাদীস যেমন আছে, আছে দুইবার করে ধোয়ার হাদীসও, সেই সাথে তিনবার করে ধোয়ার হাদীসও বিদ্যমান আছে। এখন যে ব্যক্তি তিনবার করে অঙ্গ ধৌত করবে, সে তিন হাদীসের উপরই আমল করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি একবার করে অঙ্গ ধৌত করবে, সে সুনিশ্চিতভাবে দু’টি হাদীসের উপর করেনি, এখন এই ব্যক্তি যদি এ প্রোপাগান্ডা শুরু করে দেয় যে, একবার করে অঙ্গ ধৌত করাই সুন্নাত, আর তিনবার করে ধৌত করা বেদআত ও খেলাফে সুন্নাত, তাহলে এ মুর্খতার ব্যাপারে যতই আফসোস করা হোক না কেন, তা কমই হবে, তাই নয়কি?

মোটকথা, নামধারী আহলে হাদীসরা পূর্ণ উম্মতের বিপরীত শুধু নিজের মতানুসারে يد দ্বারা এক হাত উদ্দেশ্য নিয়েছে। যেখানে পূর্ণ উম্মত يد দ্বারা এর জিনস তথা হস্তসমূহ উদ্দেশ্য নিয়ে উভয় হাত উদ্দেশ্য নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজের পক্ষ থেকে يد দ্বারা ডান হাতকে সুনির্দিষ্ট করে নিয়েছে। সেই সাথে কেবলই নিজের মত দিয়ে দুই হাতে মুসাফাহা করার ঐক্যমত্বের হাদীসকে শুধু অস্বিকারই করেনি, বরং খেলাফে সুন্নাত সাব্যস্ত করেছে।

ডান হাতে মুসাফাহা করার বিষয়টি যখন কোন কওলী, ফেলী বা তাক্বরীরী, হাসান, সহীহ বা যয়ীফ কোন হাদীস দ্বারাই প্রমাণ করতে ব্যর্থ হল, তখন আভিধানিক অর্থের দিকে দৌড়িয়েছে। বলতে শুরু করেছে যে, মুসাফাহা হাতের তালু মিলানোর নাম। অথচ এখানেও হাত তার জিনস তথা প্রকরণের হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাহলে যদি দুই ব্যক্তি তাদের হাতের বাম তালু দিয়ে মুসাফাহা করে, তাহলে আভিধানিক অর্থে এটাও মুসাফাহা বলে সাব্যস্ত হয়, কিন্তু তারা এর উপর কখনোই আমল করে না। আফসোস লাগে! না হাদীস তাদের মাথায় হাত রেখেছে, না আভিধানিক অর্থ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে কাফেরদের সামাঞ্জস্যতা যা হাদীস দ্বারা নিষিদ্ধ এটা তাদের অর্জিত হয়েছে ভালভাবেই। দৃষ্টিও ইচ্ছেমত, পছন্দও ইচ্ছেমত!

দুই হাতে মুসাফাহা উম্মতের নিরবচ্ছিন্ন আমল দুই হাতে মুসাফাহা করার বিষয়টি লক্ষ্য করুন, যাকে তারা বেদআত ও খেলাফে সুন্নাত বলে অপপ্রচার করছে। এটি কি আসলেই প্রমাণহীন? নাকি প্রমাণ আছে। ইমাম বুখারী i স্বীয় সহীহ বুখারীর ২ নং খন্ডের ৯২৬ নং পৃষ্ঠায় “বাবুল মুসাফাহা” নামে পরিচ্ছেদ স্থাপন করেছেন। যাতে তিনি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e থেকে তালীকান এ বর্ণনা এনেছেন যে, علمنى النبى صلى الله عليه وسلم التشهد وكفى بين كفيه، • “হুজুর c আমাকে তাশাহুদ শিখালেন, এমতাবস্থায় যে, আমার হাত রাসূল c এর উভয় হাতের মাঝে ছিল”। ইমাম বুখারী i এর পর “বাবুল আখজ বিল ইয়াদাইন”তথা “উভয় হাত ধরা”নামে বাব স্থাপন করেছেন। আর তাতে হাম্মাদ বিন জায়েদ i এবং আব্দুল্লাহ বিন মুবারক i এর মুসাফাহার উল্লেখ করেছেন যে, তারা উভয় হাতে মুসাফাহা করেছেন। তারপর উভয় হাতের মুসাফাহার দলীল হিসেবে উপরোক্ত বর্ণনাটি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e থেকে পূর্ণ সনদসহ এনেছেন যে, আমার হাত রাসূল c এর উভয় হাতের মাঝামাঝি ছিল। -সহীহ বুখারী-২/৯২৬, হাদীস নং-৫৯১০; সহীহ মুসলিম-১/১৭৩; সুনানে নাসায়ী-১/১৭৫

বিজ্ঞ আলেমগণ ভালভাবেই জানেন যে, ইমাম বুখারী i এর এ বাবের দ্বারা উদ্দেশ্য এটাই যে, রাসূল c ও উভয় হাতেই মুসাফাহা করতেন। আর পরবর্তীতেও এ আমলই জারী ছিল।

ইমাম বুখারী i তার তারীখের কিতাবে বলেন- حدثنى اصحابنا يحيى وغيره عن اسماعيل بن ابراهيم قال رأيت حماد بن زيد وجاء ابن المبارك بمكة فصافه بكلتا يديه • অর্থাৎ ইসমাঈল বিন ইবরাহীম i বলেন-আমি হাম্মাদ বিন জায়েদ i কে দেখেছি যে, তার কাছে আব্দুল্লাহ বিন মুবারক i মক্কা মুকার্রমায় এসেছেন, তখন তিনি উভয় হাতে মুসাফাহা করেছেন। -হাশিয়ায়ে সহীহ বুখারী-২/৯২৬

এখানে স্মর্তব্য যে, এই উভয় ব্যক্তিত্ব স্বীয় জমানার মুহাদ্দিসীনদের ইমাম ছিলেন। ইমাম আব্দুর রহমান মাহদী i বলেন যে, ইমাম হল চার জন, যথা মালেক i , সুফিয়ান সাওরী i , হাম্মাদ বিন জায়েদ i ও ইবনুল মুবারক i । (তাযকীরাতুল হুফফাজ) অন্যান্য মুহাদ্দিসীনগণও উভয় হাতের মুসাফাহার কথা উল্লেখ করেছেন।

হযরত আয়শা সিদ্দিকা e বলেন- রাসূল c এক মহিলাকে বললেন- قد بايعتك অর্থাৎ আমি তোমাকে বাইয়াত করালাম। হযরত আয়েশা e বলেন যে, তাকে শুধু কথার দ্বারা বাইয়াত করিয়েছেন, হাত ধরে বাইয়াত করাননি। আল্লামা কাশতাল্লানী i ইরশাদুস সারী শরহু সহীহ বুখারীতে এবং আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী i উমদাতুল ক্বারী শরহু সহীহিল বুখারীতে আয়শা e এর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন- اى لا باليد كما كان يبايع الرجال بالمصافحة باليدين • হাত দিয়ে বাইয়াত করাননি, যেমন পুরুষদের বাইয়াত করানোর সময় উভয় হাতে মুসাফাহা করতেন।

এ বক্তব্যের সমর্থন হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃএর স্বপ্ন দ্বারাও হয়। তিনি বলেন (স্বপ্নে) রাসূল c মুচকি হেসে আমার দিকে তার উভয় হাত বাড়ালেন। আমি নিকটবর্তী হলাম, তখন রাসূল c আমার হাতকে স্বীয় উভয় হাত মুবারকের মাঝে ধরলেন এবং মুসাফাহা করলেন। (আদ দুরারুস সামীন)

এছাড়া শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী i আল ক্বওলুল জামীল গ্রন্থে লিখেন যে, আমার পিতার সাথেও রাসূল c উভয় হাতে মুসাফাহা করেছেন। মুহাদ্দেসীনদের সাথে সাথে ফুক্বাহায়ে কেরাম যাদের অনুসরণ করার নির্দেশ কুরআন ও হাদীসে এসেছে, তারাও উভয় হাতে মুসাফাহা করাকে সুন্নাত বলেন। তাইতো মাজালিসুল আবরার নামক গ্রন্থে এসেছে যে, والسنة فيها ان تكون بكلتا اليدين • সুন্নাত হল দুই হাতে হওয়া।

এমনিভাবে ফাতওয়ায়ে শামীতে এবং আশআতুল লামআত গ্রন্থে ও আছে। তাছাড়া হাদীসে এসেছে যে, যখন মুসলমানগণ মুসাফাহা করে তখন তার গোনাহ ঝরে যায়। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ) একথাতো স্পষ্ট যে, মানুষ দুই হাতেই গোনাহ করে থাকে। তাই উভয় হাত থেকেই গোনাহ ঝরা উচিত। কিন্তু আমাদের আহলে হাদীস বন্ধুরা যেন এক হাতকে জাহান্নামের জন্য রিজার্ভ করে দিয়েছেন যে, এ হাত থেকে গোনাহ ঝরার দরকার নেই।

একবার এক আশ্চর্য মজার ঘটনা ঘটল। আমি এক গায়রে মুকাল্লিদ বন্ধুকে বুখারী শরীফের দুই হাতে মুসাফাহা করার হাদীস দেখালাম। তখন তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-“যদিও রাসূল c এর মুসাফাহার মাঝে দুই হাত ছিল, কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e এরতো এক হাতই ছিল। আর আমিতো নবী নই যে, উভয় হাতে মুসাফাহা করবো, তাই আমি এখানে নবীর বদলে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e এর অনুসরণ করি”। আমি বললাম-”যেমন আপনি নবী নন, তেমন ইবনে মাসউদ e এর মত সাহাবীও নয় যে, এক হাতে মুসাফাহা করবেন। তাই আপনি এক আঙ্গুলির সাথে অন্য আঙ্গুলি মিলিয়ে মুসাফাহা করবেন, যাতে আপনার নবী হওয়ারও কোন সন্দেহ না থাকে, আবার সাহাবী হওয়ারও কোন সন্দেহ না থাকে”।

আমি তাকে আরো বললাম- কোন হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e উভয় হাতে মুসাফাহা করেননি, একথা আসেনি। আর তাছাড়া মন একথা মানতে পারে কি যে, রাসূল c উভয় হাত মুবারক বাড়িয়েছেন। আর ইবনে মাসউদ e কেবল এক হাত বাড়িয়েছেন?

আসল কথা হল, যখন ব্যক্তি উভয় হাতে মুসাফাহা করে, তখন এক হাতের উভয় পাশে অন্যজনের উভয় হাত লেগে থাকে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e এক হাতের এ সৌভাগ্য বর্ণনা করেছেন যে, আমার এ হাতের উভয় পাশে রাসূল c এর হাত মুবারক লেগে ছিল। নিজের অপর হাত লাগোয়া ছিলনা একথা বলেননি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সহীহ বুঝ দান করুন। সুন্নাতের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১০ এপ্রিল, ২১