মাজার সংক্রান্ত ফতোয়া

মাসিক আল কাউসারসভ্যতা ও সংস্কৃতি৮ মার্চ, ২১

প্রশ্ন

অনেকে বলে মাজারকে কবর বলা যাবে না। এতে করে ওলি আল্লাহদের অসম্মান হয়। আসলে কবর ও মাজারের পার্থক্য কী? কবরকে মাজার শরীফ ও মাজার শরীফকে কবর বলা যাবে কি? মাজার শরীফের উৎপত্তি কখন এবং কোথা হতে? আওলিয়ায়ে কিরামের মাজারকে কবর বললে তাদেরকে অসম্মান করা হয় কি না? নবী c -এর কবরকে রওজা শরীফ বলা হয় কেন? মাজারকে সিজদা করা, চুমু দেওয়া, মাজারকে ভক্তি দেখিয়ে পিছন হয়ে বের হওয়া, মাজারে গিলাফ চড়ানো এবং মাজারের মধ্যে টাকা-পয়সা ফেলা, মাজারের সামনে গাছের গোড়ায় মোমবাতি জ্বালানো, আগরবাতি জ্বালানো, গোলাপ জল ছিটানো শরীয়তসম্মত কি না? না হলে ওলি আল্লাহদের মাজার বা কবরকে শ্রদ্ধা, ভক্তি ও যিয়ারতের পদ্ধতি কী? কুরআন-হাদীসের আলোকে দলিলসহ বিস্তারিত জানালে দ্বীন পালনে সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

কবর শব্দের অর্থ দাফনস্থল অর্থাৎ যে স্থানে মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয়। আর মাযার শব্দের অর্থ দুটিঃ যিয়ারত করা এবং যিয়ারত স্থল। তাই যে কোনো মুসলমানের দাফনস্থলকে যেমন কবর বলা যায় তেমনি যে কোনো মুসলমানের কবরকে আভিধানিক অর্থে মাযারও বলা যায়। কেননা, সকল মুসলমানের কবরই যিয়ারত করা বৈধ। বুযুর্গ, নেককার ও ওলিদের দাফনস্থলকে কবর বলা যাবে না এমন কোনো বিধান শরীয়তে নেই। ওলি-বুযুর্গদের কবরের জন্য কুরআন-হাদীসে কোথাও মাযার শব্দ ব্যবহার হয়নি। হাদীসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবীদের দাফনস্থলকেও কবর বলা হয়েছে। এমনকি হাদীসে রাসূলুল্লাহ c -এর কবরকেও কবর শব্দেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সহীহ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ c ইরশাদ করেছেন- ‘ইহুদী ও নাসারাদের উপর আল্লাহর লা’নত, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। -সহীহ বুখারী ১/১৮৬ এই হাদীসে নবীদের দাফনস্থলকে কবর বলা হয়েছে। অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ c তাঁর নিজের ব্যাপারেই বলেন, আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। -সুনানে আবু দাউদ ১/২৭৯

সুতরাং বোঝা গেল, যত সম্মানিত ব্যক্তিই হোক তার দাফনস্থলকে কবর বলা দোষণীয় নয়। তাই ওলি-বুযুর্গদের দাফনস্থলকেও কবর বলা যাবে।

আর রাসূলুল্লাহ c -এর দাফনস্থলকে রওযা বলার কারণ হল, রওযা শব্দের অর্থ বাগান। এখানে রওযা দ্বারা উদ্দেশ্য, ‘জান্নাতের একটি বাগান।’ যেহেতু তাঁর কবরটি জান্নাতের নেয়ামতে ভরপুর একটি পবিত্র বাগান। তাই এ অর্থে তাঁর কবরকে ‘রওযা আতহার’ (পবিত্র বাগান) বলা হয়।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হচ্ছে কবরের সঙ্গে কৃত আচরণ

কবর ইবাদত বা উপাসনার স্থান নয়। কবর সংক্রান্ত যে সব বিষয় রাসূলুল্লাহ c শিক্ষা দিয়েছেন (যথা যিয়ারত, সালাম ও দুআ) সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো কিছু করা বৈধ নয়। কবরকে সিজদা করা, চুমু খাওয়া, তাতে বাতি জ্বালানো-এগুলো বড় গুনাহ ও শিরকী কাজ। এ বিষয়ে শরীয়তের অনেক দলীল রয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস বরাতসহ পেশ করা হল।

সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ c ইরশাদ করেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী কতক উম্মত নিজ নবী ও বুযুর্গদের কবরকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরকে সিজদার স্থান বানাবে না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি। -সহীহ মুসলিম ১/২০১

অন্য এক হাদীসে কবরের উপর যারা বাতি জ্বালায় তাদের উপর রাসূলুল্লাহ c অভিসম্পাত করেছেন। -সুনানে তিরমিযী ১/৭৩ আরেক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ c হযরত আলী রা.কে এই ফরমান দিয়ে পাঠালেন যে, কোনো উঁচু কবর দেখলে তা সমান করে দিবে এবং কোনো মূর্তি দেখলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে। -জামে তিরমিযী ১/২০৩

ফিকহে ইসলামীর প্রসিদ্ধ কিতাব তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ পৃ. ৩৪১ বলা হয়েছে, কবর মুছবে না, কবরে চুমু দিবে না এবং কবরকে স্পর্শ করবে না। কেননা, এটা নাসারাদের রীতি। (সামনে এ সংক্রান্ত আরো বরাত উল্লেখ করা হয়েছে।)

উল্লেখ্য কবরে চুমু খাওয়া, সিজদা করা, তাওয়াফ করা, কবরের উপর ইমারত বানানো, গিলাফ চড়ানো, মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো ইত্যাদি একদিকে যেমন শরীয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ, অপরদিকে তা কবরবাসী ওলীদের প্রতি চরম অবিচার। কেননা, তাঁরা পুরো জীবন শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন অথচ মৃত্যুর পর তাদরে প্রতি ভক্তি নিবেদনের নামে ওই সব কাজ-ই করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সাহাবা, তাবেয়ীন এবং ওলি-বুযুর্গদের পথ-নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের ঈমান-আমল ঠিক করা, তাওহীদ ও সুন্নাহ্কে আঁকড়ে ধরা এবং শিরক-বিদআত ও সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমেই তাদেরকে প্রকৃত সম্মান করা যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন।

কবর যিয়ারতের মাসনূন তরীকা

কবর যিয়ারতের সুন্নত তরীকা হচ্ছে কবরের কাছে গিয়ে সালাম দিবে। এরপর কবরকে পিছনে রেখে কিবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে নিজের জন্য এবং কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দুআ করবে। এছাড়া কুরআন মজীদ থেকে কিছু অংশ তেলাওয়াত করে কবরবাসীর জন্য ইসালে ছওয়াব করা যেতে পারে।

- والله اعلم باالصواب -

সূত্র

  • লিসানুল আরব, খন্ড: ১১, পৃষ্ঠা:
  • আলকামুসুল মুহীত, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৬০
  • তাজুল আরূস, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪৭৮
  • তাহযীবুল লুগাহ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৪৮
  • তাজুল আরূস, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৪৫
  • সহীহ বুখারী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৮৬
  • সহীহ মুসলিম, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২০১
  • মুসনাদে আহমদ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৪৬
  • জামে তিরমিযী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৭৩
  • সহীহ বুখারী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৮৬
  • সহীহ মুসলিম, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২০১
  • জামে তিরমিযী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৭৩
  • সুনানে নাসাঈ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২২২
  • সুনানে আবু দাউদ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪৬১
  • সহীহ ইবনে হিব্বান, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪৫২
  • রূহুল মাআনী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৩৮
  • আদ্দুররুল মুখতার, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪৩৯
  • আলবাহরুর রায়েক, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৯৮
  • হাশিয়া তাহতাবী আলাল মারাকী, পৃষ্ঠা: ৩৪১
  • ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৬৭
  • আননাহরুল ফায়েক, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪২
  • ফাতাওয়া বাযযাযিয়া, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩৭২
  • মাদখাল ইবনুল হাজ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৭৩
  • ইগাছাতুল লাহফান, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২২২
  • শরহু মুসলিম নববী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪৩
  • হিলইয়াতুল আওলিয়া, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৬৯
  • শরহুস সুদূর, পৃষ্ঠা: ৩১১
  • রদ্দুল মুহতার, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৪২
  • ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩৫০
  • আলবাহরুর রায়েক, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৯৫
  • ইলাউস সুনান, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩৩০

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ৮ মার্চ, ২১