বুখারীতে বুকের উপর হাত বাঁধার কোন দলীল

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসনামায৯ মে, ২১

প্রশ্ন

আহলে-হাদীসপন্থী একজন নামাযের হাত বাধাঁর স্থান নিয়ে বুখারী শরীফের হাদীস এই হাদীসটি উল্লেখ করেন। كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أَنْ يَّضَعَ الرَّجُلُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِى الصَّلَوةِ، قَالَ أبو حَازِمٍ : لاَ أَعْلَمُ إِلاَّ يَنْمِىْ ذَالِكَ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ، رواه البخارىُّ হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানী e তাঁর ফাতহুল বারী (২/১২৪) এবং বুলুগুল মারাম (২০) কিতাবে বুকের উপর হাত বাধাঁর প্রমাণ হিসেবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করেন। এবং আল্লামা আইনিও উমদাতুল ক্বারীতে (৫/২৭৮) স্বরূপ বলেন। তার দাবীগুলো সঠিক কিনা?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

এ হাদীস বুকের উপর হাত বাঁধার দলিল বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া কেউ বলতে পারে না। ইমাম বুখারী i যে শিরোনামের অধীনে হাদীসটি এনেছেন তা হল- باب وضع اليمنى على اليسرى তথা ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ। তারপর তিনি হাদীস এনেছেন- عن سهل بن سعد قا: كان الناس يؤمرون أن يضع الرجل اليد اليمنى على ذراعه اليسرى في الصلاة . قال أبو حازم لاأعلمه إلا ينمي ذلك إلى النبي صلى الله عليه و سلم . قال إسماعيل ينمى ذلك ولم يقل ينمي • সাহাল বিন সাদ e থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকদের নির্দেশ দেওয়া হত যে, নামাযে প্রত্যেক ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখবে। আবূ হাযিম i বলেন, সাহল হাদীসটি নবীজী c থেকে বর্ণনা করতেন বলেই জানি। ইসমাইল i বলেন, এ হাদীসটি নবীজী c থেকেই বর্ণনা করা হত। তবে তিনি এরূপ বলেননি যে, সাহাল নবীজী c থেকে বর্ণনা করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭০৭

এবার বলুন! এ হাদীসের কোথায় বুকের উপর হাত বাঁধার কথা আছে? কোন দূরবর্তী বা অস্পষ্ট ইঙ্গিতও তো এখানে নেই। তাহলে এটি বুকের উপর হাত বাঁধার দলিল হল কি করে? ইমাম বুখারী i তো স্পষ্টভাবে এটাকে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। স্পষ্টতার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বুখারী শরীফের অনুবাদটি দেখতে পারেন। -বুখারী শরীফ-২/১০২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং-৭০৪

আসলে কথিত আহলে হাদীস ভাইদের দাবি অনুপাতে সহীহ কোন হাদীস বুকের উপর হাত বাঁধার ক্ষেত্রে পাচ্ছেন না। তাই আবোল তাবোল বকছেন নিজেদের অজ্ঞতা ও হাদীস না মেনে প্রবৃত্তি মনপূজার স্পষ্ট চিত্রটি ঢাকতে। অজ্ঞতার কারণ কি? উক্ত হাদীসটি দিয়ে ভুল দলীল দেয়ার কারণ মূলত ذراع ( যিরা) শব্দটি নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি। ذراع ( যিরা) শব্দ নিয়ে ধুম্রজাল ইসলামী ফিক্বহ এবং আরবী অভিধান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বা ইচ্ছেকৃত ধোঁকাবাজীর আশ্রয় নিয়ে এ শব্দ দিয়ে বুকের উপর হাত বাঁধা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়ে থাকে। বলা হয় যে, “যিরা শব্দের অর্থ নাকি কনুই। ডান হাতকে বাম হাতের কনুইয়ের উপর রাখলে নাকি হাত বুকের উপর চলে যায়। আর হাদীসে যেহেতু যিরা শব্দ এসেছে। আর যিরা মানে কনুই। তাই বুকের উপর হাত বাঁধা জরুরী।” হাস্যকর দলীল। যে কেউ নিজেই পরীক্ষা করে নিতে পারেন। যদি ওদের কথা মানাও হয় যে, “যিরা”শব্দের অর্থ কনুই। তাহলে ডান হাতকে বাম হাতের কনুইয়ের উপর রেখে হাত ছেড়ে দেখুন হাত কোথায় যায়?

সুনিশ্চিতভাবে হাতটি যাবে নাভির উপর। বুকের উপরে থাকার প্রশ্নই উঠে না। হ্যা, বুকের উপর যাবে, যদি ডান হাতকে কনুয়ে না রেখে বাম হাতের কাঁধের কাছে ধরা হয়। তাহলে তারা একেতো “যিরা”শব্দের গলদ অনুবাদ করছে। আবার বুকের উপর কথা অনুল্লেখ থাকা সত্বেও হাদীসের শব্দের মাঝে বাড়িয়ে নাভির উপর রেখে বুকের উপর হাত রাখছে। তাহলে তাদের দলীল দেয়া হাদীস মানছে? না নিজের মনের খাহেশাতের পূজা করছে? এবার দেখে নেই আসলে “যিরা”শব্দের অর্থ কি?

১. প্রসিদ্ধ আরবী লুগাত “লিসানুল আরব”গ্রন্থে লেখা হয়েছে- ذر: الذِّراع: مَا بَيْنَ طرَف المِرْفق إِلى طرَفِ الإِصْبَع الوُسْطى، তথা যারউন ও যিরা বলা হয়, কনুই থেকে নিয়ে মধ্যমা আঙ্গুল পর্যন্ত অংশকে। (লিসানুল আরব-যাল অধ্যায়)

২. একই বক্তব্য উদ্ধৃত আলকামূসুল মুহীত গ্রন্থের যাল অধ্যায়ে- الذِّراعُ، بالكس: من طَرَفِ المِرْفَقِ إلى طَرَفِ الإِصْبَعِ الوُسْطَى، একই বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে আলকামূসুল ফিক্বহ নামক গ্রন্থের যাল অধ্যায়ে। الذرا: اليد من كل حيوان، لكنها من الانسان من طرف المرفق إلى طرف الاصبع الوسطى.

৩. একই অর্থ লেখা হয়েছে আলমুহকাম ওয়ালমুহীতুল আজম নামক লুগাত গ্রন্থে। সমস্ত অভিধানগুলোতে একই অর্থ লিখিত হয়েছে।

এবার একটু যাচাই করি ফুক্বাহায়ে কেরাম এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ “যিরা”শব্দের অর্থ কি নিয়েছেন? ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ কী ব্যাখ্যা করেছেন যাইদা ইবনে কুদামার এই পাঠ হাদীস ও ফিকহের প্রাচীন গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হয়েছে। বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ তার অর্থ করেছেন ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠ, কব্জি ও বাহুর কিছু অংশের উপর রাখা। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইবনে খুযায়মা i (৩১১ হি.) সহীহ ইবনে খুযায়মায় হাদীসের এই পাঠ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ‘যিরার উপর যিরা’র অর্থ গ্রহণ করেননি। তিনি এই হাদীসের উপর শিরোনাম দিয়েছেন- باب وضع بطن الكف اليمنى على كف اليسرى والرسغ والساعد جميعا • ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর রাখা। -সহীহ ইবনে খুযায়মা ১/২৭২

বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, নামাযে হাত এমনভাবে রাখা উচিত, যাতে ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার কিছু অংশ, কব্জি ও বাহুর কিছু অংশের উপর থাকে। তাঁরা ওয়াইল ইবনে হুজর e -এর হাদীসের এই পাঠ এবং হযরত সাহল ইবনে সাদ e -এর হাদীসকে দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইবনে কুদামা হাম্বলী i (৬২০ হি.) বলেন, (নামাযে) ডান হাত বাম হাতের কব্জি ও তৎসংলগ্ন অংশের উপর রাখা মুস্তাহাব। কারণ হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর e থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর রাসূল c -এর নামাযের বিবরণ দিয়েছেন এবং সে বিবরণে বলেছেন, ‘অতপর তিনি তাঁর ডান হাত রাখলেন তার বাম হাতের পাতার পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর।’ -আলমুগনী ২/১৪১

একই কথা বলেছেন আল্লামা ইবনে কুদামা মাকদেসী i (৬৮২ হি.)। (আশশারহুল কাবীর (আলমুগনীর সাথে মুদ্রিত) ১/৫৪৯) ইমাম নববী i (৬৭৬ হি.) ‘‘শরহুল মুহাযযাব’’ গ্রন্থে (৪/৩২৭) শাফেয়ী মাযহাবের মনীষীদের সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন যে, ‘সুন্নাহ হচ্ছে, তাকবীরে (তাহরীমার) পর দুই হাত নামিয়ে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে এবং ডান হাতের পাতা দ্বারা বাম হাতের পাতার গোড়া এবং কব্জি ও বাহুর কিছু অংশ ধরবে। কাফফাল বলেছেন, ডান হাতের আঙ্গুল আড়াআড়িভাবে কব্জির উপর রাখা বা বাহুর উপর ছড়িয়ে দেওয়া দুটোরই অবকাশ আছে। এরপর বলেন, (পৃ. ৩২৯) আমাদের মনীষীগণ সাহল ইবনে সাদ e -এর হাদীস দ্বারা এ নিয়ম প্রমাণ করেছেন। তেমনি ওয়াইল ইবনে হুজর e থেকেও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘অতপর (আল্লাহর রাসূল c তাঁর ডান হাত রাখলেন বাম হাতের পাতার পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর।’

ইমাম আবুল ওয়ালিদ আলবাজী i (৪৯৪ হি.) হযরত সাহল ইবনে সাদ e -এর হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ হাদীসের অর্থ হচ্ছে, ডান হাত কব্জির উপর রাখবে। কারণ ডান হাত বাম হাতের পাতার উপর রাখা যাবে না। তা রাখতে হবে বাম হাতের গোড়া ও কব্জির উপর। আর তার উপর ভর দেওয়া যাবে না। -আলমুনতাকা শারহুল মুয়াত্তা ২/১৬৪

ইমাম আবুল আববাস আহমদ ইবনে উমার আলকুরতুবী i সহীহ মুসলিমে বর্ণিত ওয়াইল ইবনে হুজর e -এর হাদীসের আলোচনায় বলেন, ইবনুল মাজিশূন ইমাম মালিক i থেকে বর্ণনা করেছেন যে, (নামাযী) ডান হাত দ্বারা তার বাম হাতের গোড়া ও কব্জি পেঁচিয়ে ধরবে। উপরের হাদীসটি তার দলীল। -আলমুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম ২/২১

ইবনে তাইমিয়া i ও ইবনে হাযম i আল্লামা ইবনে তাইমিয়া i নামাযে হাত বাঁধার নিয়ম সম্পর্কে বলেন, ‘তাকবীর সমাপ্ত হওয়ার পর দুই হাত ছেড়ে দিবে এবং ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর এমনভাবে রাখবে যে, ডান হাত দ্বারা কব্জির গোড়ার হাড় পেঁচিয়ে ধরবে কিংবা ডান হাত কব্জির উপর এমনভাবে বিছিয়ে দিবে যে, হাতের আঙ্গুলিসমূহ যিরার দিকে (ছড়ানো) থাকে। ডান হাত যদি কব্জির ওপরের দিকে (যিরার উপর) কিংবা কব্জির নিচে বাম পাতার উপর রাখে তবে সেটাও জায়েয।’ এরপর তিনি হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর e -এর হাদীস, যাইদা ইবনে কুদামার বর্ণনা, সাহল ইবনে সাদ e -এর হাদীস ও হুলব e -এর হাদীসকে দলীল হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন। -শরহুল উমদা পৃ. ৬৫-৬৬

আল্লামা ইবনে হাযম i (৪৫৬ হি.) ‘‘আলমুহাল্লা’’ গ্রন্থে (৩/২৯-৩০) নামাযে হাত বাঁধার বিষয়ে বলেছেন, ‘মুস্তাহাব এই যে, নামাযী কিয়ামের হালতে তার ডান হাত বাম হাতের পাতার গোড়ায় রাখবে।’ এরপর তিনি সাহল ইবনে সাদ e -এর হাদীসসহ আরো কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। আলোচনার শেষে বলেন, ‘আবু মিজলায, ইবরাহীম নাখায়ী, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, আমর ইবনে মায়মূন, মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন, আয়্যুব ছাখতিয়ানী ও হাম্মাদ ইবনে সালামা থেকেও আমরা বর্ণনা পেয়েছি যে, তাঁরাও (নামাযে) এভাবে করতেন (হাত বাঁধতেন)। আর এটি আবু হানীফা, শাফেয়ী, আহমদ ও দাউদ-এর সিদ্ধান্ত। আল্লামা শাওকানী i ও (১২৫৫ হি.) ওয়াইল ইবনে হুজর e -এর হাদীসের এই ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘হাদীসের অর্থ এই যে, ডান হাত বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর উপর রাখবে।

তবারানীর রেওয়ায়েতে আছে, (আল্লাহর রাসূল c নামাযে তাঁর ডান হাত রাখলেন বাম হাতের পিঠের উপর কব্জির কাছে। (ইমাম) শাফেয়ী i -এর শাগরিদরা বলেছেন, ডান হাতের পাতা দ্বারা বাম হাতের পাতার গোড়া, কব্জি ও বাহুর কিছু অংশ পেঁচিয়ে ধরবে। হাদীসটি হাতের পাতা হাতের পাতার উপর রাখার বৈধতা প্রমাণ করে। এটিই অধিকাংশ মনীষীর গৃহীত নিয়ম। …’ এরপর তিনি নামাযে হাত ছেড়ে রাখার প্রসঙ্গ আলোচনা করেন।

উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা আশা করি স্পষ্ট হয়েছে যে, বুখারীতে আসলে বুকের উপর হাত বাঁধার কোন দলীলই নেই। যারা বুকের হাত বাঁধার রেফারেন্স বুখারী দিয়ে দিচ্ছেন, তারা পরিস্কার মিথ্যাচার করছেন। আল্লাহ তাআলা এসব মিথ্যুকদের মিথ্যাচার থেকে উম্মতকে হিফাযত করুন। আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ৯ মে, ২১