বুকের উপর হাত বাঁধা

ইসলামী জিন্দেগীনামায২২ ফেব, ২১

প্রশ্ন

কিছু লা-মাযহাবী ভাইয়েরা বলে থাকে বুকের উপর হাত বাধার সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তারা দাবী করে তাদের সব হাদীস সহীহ। আসলে তারা যে দলীল পেশ করে এই সকল হাদীসের ভিত্তি কী?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

বুকের উপর হাত বাঁধা সম্পর্কে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এক্ষেত্রে যে দলীলসমূহের আশ্রয় নেয়া হয়, সেগুলোর অবস্থা নিম্নরূপঃ-

(১) হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর e এর হাদীস (সহীহ ইবনে খুযাইমাঃ১/২৭৩, হা. নং ৪৭৯) এটি সহীহ হাদীস নয়। এর সনদে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল আছেন। তিনি সুফিয়ান সাওরী থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। মুয়াম্মালকে ইমাম বুখারী ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন এবং তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘আমি যাকে মুনকারুল হাদীস বলবো, তার সূত্রে বর্ণনা করা বৈধ হবে না’।

ইবনে সা’দ, আবূ যুর‘আ রাযী, আবূ হাতেম রাযী ও দারাকুতনী প্রমূখ মুয়াম্মালকে ‘অত্যধিক ভুলের শিকার’ আখ্যা দিয়েছেন।

ইবনে হাজার আসকালানী রহ.‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেছেনঃ

(مؤمل بن إسماعيل فى حديثه عن الثوري ضعيف) সুফিয়ান হতে মুয়াম্মালের বর্ণনায় দুর্বলতা আছে। (৫১৭২ নং হাদীসের অধীনে) এবং সুফিয়ান সাওরীর অন্য বর্ণনার বিপরীত। আর এই হাদীসে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলেরই যে ভুল হয়েছে তা ওয়াইল ইবনে হুজর e হতে বর্ণিত রিওয়ায়াতগুলোর সনদে নজর বুলালেই প্রমাণ হয়। ওয়াইল ইবনে হুজর e থেকে হাদীসটি রিওয়ায়াত করেছে তার ছাত্র কুলাইব, তার থেকে আসেম, আর আসেম থেকে রিওয়ায়েত করেছে তার নয়জন ছাত্র, যথাঃ

১. বিশর ইবনে মুফাজ্জাল

২. যায়েদা

৩. আব্দুল্লাহ ইবনে ইদরীস

৪. আব্দুল ওয়াহেদ

৫. শু‘বা

৬. যুহাইর ইবনে মু‘আবিয়া

৭. সালাম ইবনে সুলাইম

৮. খালেদ ইবনে আব্দুল্লাহ

৯. সুফিয়ান সাওরী

আসেমের এই নয়জন ছাত্রের আটজনই (على الصدر) ‘বুকের উপর’ উল্লেখ করেননি। শুধু সুফিয়ান সাওরীর সূত্রে এই শব্দটি পাওয়া যায়। আর সুফিয়ান সাওরীর দুইজন ছাত্র এই হাদীসটি তার থেকে রিওয়ায়াত করেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ালীদ এবং মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল। এই দুইজনের মধ্য থেকে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ালীদও ‘বুকের উপর’ শব্দটি উল্লেখ করেননি। শুধু মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলই ‘বুকের উপর’ শব্দ উল্লেখ করেছেন। আর খোদ ইমাম সুফিয়ান সাওরীর আমলও এই হাদীস অনুযায়ী ছিল না। ইমাম নববী লিখেন, ‘ইমাম আবূ হানীফা, সুফিয়ান সাওরী, ইসহাক ইবনে রাহুয়া ও আমাদের শাফেয়ীদের মধ্যে আবূ ইসহাক মারওয়াযী বলেন, উভয় হাত নাভির নিচে বাধবে।’

এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ‘বুকের উপর’ শব্দটি মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল ভুলবশত বৃদ্ধি করেছেন। তাই এই হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। -শরহে মুসলিমঃ১/৭৩, আবূ দাউদঃ১/১১২, মুসনাদে আহমাদঃ৪/৩১৮, বাইহাকীঃ২/১৩১

(২) ত্বাউস i বলেনঃ

عَنْ طَاوُسٍ، قَال: «كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَضَعُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى يَدَهُ الْيُسْرَى ثُمَّ يَشُدُّ بِهِمَا عَلَى صَدْرِهِ وَهُوَ فِي الصَّلَاةِ» (أبو دود- ৭৫৯)وعزاه المزنى(-১৮৮ ২৯) إلى أبى دود فى المراسيل-

তাউসের বর্ণনাটি আবূ দাউদ শরীফের ৭৫৯ নং হাদীস । এটি ‘মুরসাল’ তথা সূত্র বিচ্ছিন্ন, আর মুরসালকে তারা প্রামাণ্য মনে করে না। তদুপরি এতে ‘সুলাইমান ইবনে মূসা’ নামের একজন রাবী আছেন। তার সম্পর্কে বুখারী i বলেছেনঃ (عنده مناكير) তার কাছে অনেক মুনকার বিষয় আছে। ইমাম নাসাঈ i বলেছেনঃ (ليس بالقوي) তিনি মজবুত রাবী নন। (দ্রঃ আল- কাশিফ)

(৩) বুকের উপর হাত বাঁধা সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস e থেকে একটি হাদীস বাইহাকীতে আছে (বাইহাকী হা. নং ২১৩৩)। এর সনদে রওহ ইবনুল মুসায়্যাব আছেন। তিনি চরম দুর্বল রাবী। ইবনে হিব্বান i তার সম্পর্কে বলেছেনঃ তিনি বিশ্বস্ত লোকদের সূত্রে জাল হাদীস বর্ণনা করতেন। তার থেকে হাদীস নেওয়া জায়েয নেই। ইবনে আদী বলেছেনঃ(أحاديثه غير محفوظة) তার হাদীস সঠিক নয়। -তাহযীবুত তাহযীবঃ৪/২৩১

(৪) হযরত আলী e এর হাদীসটি বুখারীর ‘তারীখে কাবীরে’ আছে। আবার এই হাদীসটি একই সনদে ইবনে আবী হাতেম ‘আল জারহু ওয়াত্ তা’দীল’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেখানে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার কথা আছে ‘বুকের উপর’ (على الصدر) কথাটি নেই। তেমনিভাবে মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় এটি উল্লেখ আছে। সেখানেও ‘বুকের উপর’ কথাটি নেই। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাঃ হাঃ নং ৩৯৬২

উপরন্তু, ইমাম বুখারী ‘আত্ তারীখুল কাবীর’ গ্রন্থে উক্ত হাদীসটিকে সমর্থন করেননি। বরং সেটি উল্লেখ করার পর বলেছেনঃ

وَقَالَ قُتَيب: عَنْ حُمَيد بْن عَبد الرَّحمَن، عَنْ يَزِيد بْن أَبي الجَعد، عَنْ عاصم الجَحدَرِيّ، عَنْ عُقبة مِن أصحابِ عليٍّ، عن عليٍّ، رضي الله عَنْهُ؛ وضعها على الكرسوع.

অর্থঃ কুতাইবা i হুমাইদ ইবনে আব্দুর রহমানের সূত্রে ইয়াযীদ ইবনে আবূল জা’দ থেকে, তিনি আসিম জাহ্দারীর সূত্রে হযরত আলী e এর ছাত্র উকবা থেকে, তিনি হযরত আলী e থেকে বর্ণনা করেছেনঃ তিনি তার হাত কব্জির উপর রাখলেন। -আত্ তারীখুল কাবীরঃ জীবনী নং ৬৪৩৭

এ কারণেই আল্লামা ইবনে কাছীর i স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে সূরা কাউছার-এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ (يُرْوَى هَذَا عَنْ عَلِيٍّ وَلَا يَصِحُّ) এ হাদীসটি সহীহ নয়।

(৫) হযরত হুলব e এর হাদীসটি মুসনাদে আ‏হমাদে ৫/২২৬, হা. নং ২২০২৮) আছে। সুফিয়ান থেকে শুধু ইয়াহইয়াই বুকের উপর হাত বাঁধার কথাটি উল্লেখ করেছেন। মুসনাদে আহমাদে ও দারাকুতনীতে ওয়াকী ও আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী i দু’জন সুফিয়ান থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় বুকের উপর হাত বাঁধার কথা নেই। তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদে সুফিয়ানের সঙ্গী আবূল আহওয়াস একই উস্তাদ সিমাক থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। তাদের কারও বর্ণনাতেই বুকের উপর হাত বাঁধার কথা নেই। সুতরাং এটি ‘শায’ (দুষ্প্রাপ্য) হাদীস, যা গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লামা নিমাবী i ‘আসারুস সুনান’ নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ

وَ يَقَعُ فِيْ قَلْبِي: أَنَّ هٰذَا تَصْحِيْفٌ مِنَ الْكَاتِبِ، وَ الصَّحِيْح: يَضَعُ هٰذِهٖ عَلى هذِهٖ، فَيُنَاسِبُه قَوْلُ: وَصَفَ يَحْيٰى الْيُمْنٰى عَلَى الْيُسْرٰى فَوْقَ الْمُفَصَّلِ وَ يُوَافِقُه سَائِرُ الرِّوَايَاتِ.

অর্থঃ আমার মনে হয়, على صدره (বুকের উপর) কথাটি অনুলেখকের ভুলের কারণে হয়েছে। সঠিক হলোঃ এ হাতটি এ হাতের উপর রেখেছেন, এতে করে এটি পরের কথার সঙ্গেও এর মিল হয়। কারণ, পরে বলা হয়েছেঃ ইয়াহইয়া ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রেখে দেখিয়েছেন। আর এটি তখন অন্যান্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ হয়। -আসাররুস সুনানঃ ১০৮

এ হিসেবে এই হাদীসটি হানাফীদের সমর্থন-সূচক দলীল হয়ে যায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, লা-মাযহাবীদের একটি দলীলও সহীহ নয়।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং তদনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২২ ফেব, ২১