বাংলাদেশে কি জিহাদ করা ফরজ হয়ে গেছে

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসজিহাদ২৩ মে, ২১

প্রশ্ন

আজকাল আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ইন্টারনেটে কিছু মানুষ কে জিহাদ ও কিতালের কথা বলতে শুনছি। আমি ইরাক, আফগানিস্তানে জিহাদের কট্টর সমর্থক। এ ব্যাপারে আমি তাদের সাথে একমত। কিন্তু খটকা লাগছে এই জায়গায় যে, তারা আমাদের এই দেশে কিতাল করার কথা বলছেন। এদেশের আর্মি, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি সব নাকি মুরতাদ, তাগুতের বাহিনি। আমাদেরকে নিকটবর্তী কাফিরের সাথে যুদ্ধ করতে হবে বলে উদ্বুদ্ধ করছেন। তাছাড়া, মোল্লা ওমর i থেকেও নাকি এ ধরনের নির্দেশনা এসেছে বলে উনারা বলছেন। ঐখানের উমারারা নাকি বাংলাদেশে কিতাল করতে বলেছেন, এদেশে মারেকা তৈরি করতে বলেছেন।

ইদানিং সাধারণ শিক্ষিত ইন্টারনেট ব্যাবহারকারি তরুণদের মাঝে তাদের এই চিন্তা তারা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি তাদের এই কাজে তারা কলেজ ভার্সিটির ছেলেদেরও টার্গেট করেছে বলে আমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আরো অনেকের কর্মকান্ডে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছি। জনগণের ঈমানী হালত উন্নয়নের জন্য ব্যাপকভাবে দাওয়াতি কাজ না করে,জনগণকে প্রস্তুত না করে এভাবে হঠকারিভাবে যাকে তাকে তাকফির করে জিহাদের নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে মনে হয়। এই বিষয়টা নিয়ে বড়ো পেরেশানিতে আছি হুজুর। একটু সমাধান দিবেন।তাদের দাবিগুলো কি ঠিক? ঠিক না হলে কিভাবে আমার ভাই বন্ধুদের এই রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনা যায়?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

শুধু কুরআনের বাহ্যিক অর্থ পড়েই যদি দ্বীনের হাকীকত বুঝা যেত তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে নবী রাসূল প্রেরণ করতেন না। বরং কোন পাহাড়ে বা গুহায় বা কোন পবিত্র স্থানে আসমান থেকে কিতাব নাজিল করে জানিয়ে দিতেন যে, এ কিতাব অনুযায়ী সবাই আমল কর। আল্লাহ তাআলা কোন যুগে কিতাবুল্লাহ তথা আল্লাহর বিধান সম্বলিত কিতাব পাঠিয়েছেন, কিন্তু রিজালুল্লাহ তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধান ব্যাখ্যাকারী পাঠাননি এমন কখনোই হয়নি। কারণ, হল, আসলে কিতাবে আল্লাহ তাআলা কি বুঝাতে চেয়েছেন, তা সবাই শুধু বাহ্যিক অর্থ পড়েই বুঝতে সক্ষম হবে না। আল্লাহর বাণীল নিগুঢ় তথ্য ও অন্তর্নিহিত মর্মার্থ সবাই শুধু আরবী জানলেই বা আরবীতে দক্ষতা থাকলেই অর্জন করবে না।

এ কারণেই প্রতিটি যুগেই কিতাবের সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা কিতাবের ব্যাখ্যাকার নবীকে পাঠিয়েছেন। যেন নবীর ব্যাখ্যার আলোকে মানুষ কিতাবের মূলার্থ, সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে পারে। বর্তমান সময়ে ফেরক্বাবাজীর মূল কারণ হল, নিজের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতা সত্বেও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হয়ে ব্যাখ্যা না জেনেই কুরআন ও হাদীসের বাহ্যিক অর্থ ও অনুবাদ দেখেই নিজের পক্ষ থেকে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়া। আর এ সিদ্ধান্তকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মনে করা। এরকম মানসিকতাই গোমরাহীর মূল কারণ। কোন মুসলমানকে কাফের বলা জায়েজ নয় যদি কোন ব্যক্তি ইসলামের জরূরী বিষয়কে মান্য করে, কিন্তু গোনাহগার। তাহলে উক্ত গোনাহের কারণে লোকটিকে কাফের বলা জায়েজ নয়। হারাম। কুরআন ও হাদীসে এ ব্যাপারে কড়া ধমকী এসেছে। يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَتَبَيَّنُوا وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَىٰ إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فَعِنْدَ اللَّهِ مَغَانِمُ كَثِيرَةٌ ۚ كَذَٰلِكَ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلُ فَمَنَّ اللَّهُ عَلَيْكُمْ فَتَبَيَّنُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا • হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর কর, তখন যাচাই করে নিও এবং যে, তোমাদেরকে সালাম করে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলমান নও। তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদ অন্বেষণ কর, বস্তুতঃ আল্লাহর কাছে অনেক সম্পদ রয়েছে। তোমরা ও তো এমনি ছিলে ইতিপূর্বে; অতঃপর আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। অতএব, এখন অনুসন্ধান করে নিও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খবর রাখেন। -সূরা নিসা-৯৪

হাদীসে রাসূল c যে ব্যক্তি কাফের না তাকে কাফের বললে, সেই কুফরী নিজের দিকে প্রত্যাবর্তন করে মর্মে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন- عن أبي ذر رضي الله عنه أنه سمع النبي صلى الله عليه و سلم يقول (لا يرمي رجل رجلا بالفسوق ولا يرميه بالكفر إلا ارتدت عليه إن لم يكن صاحبه كذلك) • হযরত আবু জর e থেকে বর্ণিত। রাসুল c বলেছেন যে, তোমাদের কেউ যদি কাউকে ফাসেক বলে, কিংবা কাফের বলে অথচ লোকটি এমন নয়, তাহলে তা যিনি বলেছেন তার দিকে ফিরে আসবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৬৯৮

কত মারাত্মক হুশিয়ারী, তাই কাউকে কাফের, মুশরিক, নাস্তিক বলার ক্ষেত্রে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কাফের বলার ক্ষেত্রে উসূল আল্লামা মোল্লা আলী কারী i শরহে ফিক্বহুল আকবারে বলেন- ان المسئلة المتعلقة بالكفر اذا كان له تسع وتسعون احتمالا للكفر واحتمال واحد فى نفيه فالاولى للمفتى والقاضى ان يعمل بالاحتمال النافى، لان الخطا فى ابقاء الف كافر اهون من الخطاء فى افناء مسلم واحد، • কুফরী সম্পর্কিত বিষয়ে, যখন কোন বিষয়ে ৯৯ ভাগ সম্ভাবনা থাকে কুফরীর, আর এক ভাগ সম্ভাবনা থাকে, কুফরী না হওয়ার। তাহলে মুফতী ও বিচারকের জন্য উচিত হল কুফরী না হওয়ার উপর আমল করা। কেননা ভুলের কারণে এক হাজার কাফের বেচে থাকার চেয়ে ভুলে একজন মুসলমান ধ্বংস হওয়া জঘন্য। -শরহু ফিক্বহুল আকবার-১৯৯

সুতরাং কারো কোন কাজে সন্দেহ হলেই তাকে কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক ইত্যাদি বলে প্রচার করা জায়েজ নয়। প্রথমে উক্ত বিষয়টি যাচাই বাছাই করে সত্যাসত্যি জেনে তারপর ফাতওয়া দিতে হবে। বেধড়ক যাকে তাকে কাফের, নাস্তিক-মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা, মুসলমান হত্যা করা ইসলামের বিধান নয়, শয়তানের বিধান। দারুল হরবে সবার উপর জিহাদ ফরজ হয়। দারুল আমান বা দারুল ইসলামে নয়। আর বাংলাদেশ দারুল ইসলাম না হলেও দারুল আমান। তাই বাংলাদেশে জিহাদ ফরজ হয়ে গেছে, শসস্ত্র জিহাদে নামতে হবে বলা বিশৃংখা সৃষ্টি আর দ্বীনের অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশ দারুল আমান। তাই এখানে শসস্ত্র জিহাদ বর্তমানে করা জায়েজ নয়। দারুল আমানের বিধান দারুল আমান সরাসরি যেমন দারুল ইসলাম নয়। আবার ইসলাম বিদ্বেষী দারুল হরবও নয়। তাই এতে পরিপূর্ণভাবে ইসলামী বিধান যেমন প্রয়োগ করা যাবে না, ঠিক তেমনি দারুল হরবের কঠোরতাও এর মাঝে নেই। কারণ দারুল আমানে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করতে সক্ষম। ধর্ম প্রচারেও রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। তাই দারুল ইসলাম এবং দারুল হরবের বিধানের মাঝামাঝি পর্যায়ের হবে দারুল আমানের বিধান।

১. দারুল আমানে ইসলামী শরীয়তের শাস্তি-বিধান প্রয়োগ হবে না।

২. দারুল আমানের মুসলমানদের বিষয়-আশয়ের ফায়সালা দারুল ইসলামের আদালতে হবে না।

৩. দারুল আমানের বাসিন্দাদের উপর হিজরত করা আবশ্যক নয়।

৪. দারুল আমান রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে মুসলমানদের প্রচেষ্টা করা জায়েজ আছে। যেমন সাহাবায়ে কেরাম আবিসিনিয়ার বাদশাকে সাহায্য করেছেন তার দুশমনদের বিরুদ্ধে। তবে শর্ত হল, রাষ্ট্রপক্ষ যেন কোন মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের কার্যকলাপে লিপ্ত না হয়।

৫. শরয়ী বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা যেমন দারুল হরবের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে মাজুর মনে করা হয়, তেমন দারুল আমানের বাসিন্দাদের মনে করা হবে না। অর্থাৎ শরয়ী বিধান না জানা তাদের জন্য কোন উজর বলে সাব্যস্ত হবে না। সকলের জন্য শরয়ী বিধান জানা জরুরী।

৬. স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে একজন দারুল আমান ছেড়ে দারুল ইসলামে চলে গেলে দেশ ভিন্ন হওয়ার কারণে স্বামী ও স্ত্রীর বন্ধন নষ্ট হবে না। বরং বহাল থাকবে।

৭. দারুল আমানে কোন মুসলিম বা অমুসলিমের সাথে গায়রে শরয়ী লেনদেন জায়েজ নয়। যেমন দারুল ইসলামে বৈধ নয়।

৮. দারুল আমানে বসবাসকারী ব্যক্তিগণ দারুল ইসলামের আত্মীয় থেকে মিরাস পাবে, খোরপোষ সবই পাবে। তাদের পরস্পরের জন্য ওসিয়ত করা জায়েজ আছে। -কামুসুল ফিক্বহ-৩/৩৯৫-৪০৪

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২৩ মে, ২১