প্রচলিত বিউটি পার্লার ও মেয়েদের সাজ-সজ্জার শরয়ী বিধান

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসসভ্যতা ও সংস্কৃতি১০ মে, ২১

প্রশ্ন

আমি আমার নিজের বাসায় একটি বিউটি পার্লার খুলতে চাচ্ছি। ইচ্ছে আছে এমনভাবে পার্লারটি চালাবো যে, তাতে শরীয়ত গর্হিত কোন কাজ হবে না ইনশাআল্লাহ। এ কারণে নিচে পার্লার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদী উল্লেখ করছি, যা পার্লারে সাধারণত করা হয়ে থাকে। দয়া করে পরিস্কার ভাষায় জানাবেন যে, এর মাঝে কোন কাজটি জায়েজ আর কোন কাজটি নাজায়েজ? যাতে করে আমি গোনাহ করা থেকে বেঁচে দ্বীন মেনে পার্লারটি চালাতে পারি। যাতে করে যারা পর্দায় থাকেন, তারাও পার্লারে আসতে পারেন নিঃসংকোচে। যেসব কাজ পার্লারে করা হয়ে থাকে সাধারণত-

১. মহিলা ও নাবালেগ বাচ্চাদের চুল কাটা হয়।

২. চুল রং করা। কালো খেজাব লাগানো হয়ে থাকে বয়স লুকানোর জন্য। এছাড়া আরো অন্যান্য কালারও করা হয়।

৩. চুলকে বিভিন্নভাবে সাজানো হয়। ঝুঁটি বাঁধাসহ বিভিন্ন প্রকারের চুলের কাটিং করা হয়ে থাকে।

৪. ফ্যাসিয়াল করা হয়। অর্থাৎ মুখকে পরিস্কার সৌন্দর্যমন্ডিত করার জন্য চেহারায় বিভিন্ন প্রকার ক্রিম মালিশ করা হয়।

৫. হাত-পা মালিশ করা হয়।

৬. ভ্রু চিকণ করা হয়।

৭. হাত পায়ের চুল উপড়ানো হয়।

৮. চেহারার চুল উপড়ানো হয়। অর্থাৎ দাড়ি, গোফ, কপালে ইত্যাদিতে গজানো চুল উপড়ানো হয়ে থাকে।

৯. বধু সাজানো হয়।

প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে যদি পরিস্কার ধারণা দিতেন শরীয়তের আলোকে তাহলে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। আরেকটি বিষয়, এসবের মাঝে যে কাজগুলো জায়েজ, তা কি পর্দানশীন ও পর্দহীন সবার জন্যই জায়েজ? নাকি ভিন্নতা আছে?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

সাজগোজ করা, পরিপাটি থাকা এটি মহিলাদের স্বভাবজাত বিষয়। ইসলাম মেয়েদের স্বভাবজাত এ সাজসজ্জার মানসিকতার বিরোধী নয়। তবে এক্ষেত্রে শরয়ী সীমা অতিক্রম করা জায়েজ নয়। এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যদ্ধারা আল্লাহ ও রাসূলের বিধান লঙ্ঘিত হয়। সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি হল, যে কাজ ইসলামে সম্পূর্ণ অবৈধ, সেকাজ কোনভাবেই কারো জন্যেই করা জায়েজ নয়। এমনকি স্বামীকে খুশি করার জন্যও করা জায়েজ নয়।

আল্লাহর নবী c স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللَّهِ • আল্লাহ তাআলা অবাধ্য হয়ে কোন সৃষ্টির আনুগত্ব করা জায়েজ নয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১০৯৫, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১৭০৭ আর সাজগোজের যেসব বিষয় জায়েজ, তা গায়রে মাহরাম পুরুষদের দেখানোর জন্য করলে জায়েজ নয়, এতে করে সাজগোজকারী গোনাহগার হবে। তবে স্বামীকে খুশি করার জন্য যদি সাজগোজ করে তাহলে এতে সওয়াব পাবে।

বর্তমানে প্রচলিত বিউটি পার্লারের অনেক কাজ জায়েজ হলেও অনেক নাজায়েজ কাজও রয়েছে। জায়েজ কাজগুলো যদি শরয়ী পর্দা রক্ষা করে করা হয়, তাহলে সে বিউটি পার্লার চালাতে শরয়ী কোন বাঁধা নেই। তবে যদি গায়রে শরয়ী কাজ করে, তাহলে যে করল সেও গোনাহগার হবে, যার মাধ্যমে করলো সেও গোনাহগার হবে। আপনার প্রশ্নটির বিস্তারিত জবাব নিচে উদ্ধৃত করা হল।

চুল কাটাঃ

মহিলাদের জন্য মাথার চুল যেকোন অংশ থেকেই হোক কাটা বা উপড়ানো কোনটিই জায়েজ নয়। কারণ এতে করে পুরুষের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। পুরুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ করার ব্যাপারে হাদীসে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَال: «لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ» হযরত ইবনে আব্বাস e থেকে বর্ণিত। রাসূল c অভিশাপ করেছেন সেসব পুরুষের উপর যারা মহিলাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে, আর সেসব মহিলাদের উপর যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৮৫, ৫৫৪৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৯০৪ অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- عَنْ عَلِيٍّ قَال: نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تَحْلِقَ الْمَرْأَةُ رَأْسَهَا • হযরত আলী e থেকে বর্ণিত। রাসূল c মহিলাদের চুল কামাতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৯১৪, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৪৪৭, সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৫০৪৯

এ কারণে মহিলাদের জন্য মাথার চুল কামানো জায়েজ নয়। তবে যদি কোন কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে প্রয়োজনের কারণে চুল কর্তন করা জায়েজ আছে। তবে এক্ষেত্রে যখনি উজর দূরিভূত হয়ে যাবে, তখন থেকে আর কাটা জায়েজ হবে না। -রদ্দুল মুহতার, ৬/৪০৭; খুলাসাতুল ফাতাওয়া, ৪/৩৭

একই হুকুম বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী মেয়েদের বেলায়ও প্রযোজ্য। অর্থাৎ তাদের জন্য চুল কাটানো জায়েজ নয়। তবে যদি বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী বয়সে উপনিত না হয়, তাহলে এমন শিশুদের সৌন্দর্য বাড়াতে, বা অন্য কোন কারণে সাজতে চুল কাটানোয় কোন সমস্যা নেই। তবে এক্ষেত্রেও কাফের বা ফাসেকদের নির্দিষ্ট ষ্টাইল বা ফ্যাশন নকল না করা উচিত।

চুল রং করাঃ

চুলকে রঙ্গীন করাতে কোন সমস্যা নেই। যদি অন্য কোন হারাম কাজ না করা হয়, তাহলে এমনিতে মহিলাদের চুল রঙ্গিন করাতে শরয়ী কোন নিষিদ্ধতা নেই।

চুল ঝুঁটিকরণঃ

চুল কাটা ছাড়া বিভিন্ন প্রকার ঝুঁটি ও ডিজাইন করাতেও শরয়ী কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَال: بِتُّ لَيْلَةً عِنْدَ مَيْمُونَةَ بِنْتِ الحَارِثِ خَالَتِي، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَهَا فِي لَيْلَتِهَا، قَال: «فَقَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ، فَقُمْتُ عَنْ يَسَارِهِ» قَال: «فَأَخَذَ بِذُؤَابَتِي فَجَعَلَنِي عَنْ يَمِينِهِ» • হযরত ইবনে আব্বাস e থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি আমার খালা মায়মূনা বিনতে হারিসের নিকট রাত যাপন করছিলাম। ঐ রাতে রাসূল c ও তাঁর কাছে ছিলেন। ইবনে আব্বাস e বলেন, রাসূল c উঠে রাতের সালাত আদায় করতে লাগলেন। আমি তাঁর বাম পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন তিনি আমার চুলে ঝুটি ধরে আমাকে তাঁর ডান পাশে নিয়ে দাঁড় করালেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৯১৯, ৫৫৭৫

তবে এক্ষেত্রে কাফের বা কোন ফাসেক মহিলার ডিজাইন ও ষ্টাইল যেন নকল না করা হয় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ ফাসেক ও কাফেরের সাদৃশ্য গ্রহণ জায়েজ নয়। عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ » • হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর e থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। -আবু দাউদ শরীফ, হাদিস নং-৪০৩৩, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদিস নং-২৯৬৬, মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং-২০৯০৮৬

ফ্যাসিয়াল ও হাত পা মালিশ করাঃ

শরয়ী সীমায় থেকে সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে মহিলাদের জন্য ফ্যাসিয়াল করা, ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা, হাত পা মালিশ করা জায়েজ আছে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন শরয়ী সীমা লঙ্ঘিত না হয়। যেমন মালিশ করতে গিয়ে যে অঙ্গ ধরা স্বামী ছাড়া কারো জন্য জায়েজ নয়, তা স্পর্শ করা ইত্যাদি। যদি এমনটি করা হয়, তাহলে তা হারাম হবে।

ভ্রু চিকন করাঃ

ভ্রু সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা জায়েজ নয়। হারাম। হাদীসে এসেছে- عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَال: «لَعَنَ اللَّهُ الوَاشِمَاتِ وَالمُسْتَوْشِمَاتِ، وَالمُتَنَمِّصَاتِ وَالمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ، المُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللَّهِ» مَا لِي لاَ أَلْعَنُ مَنْ لَعَنَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهُوَ فِي كِتَابِ اللَّهِ • হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ e থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে যে নারী উলকী উৎকীর্ণ করে ও করায়, যে নারী ভ্রু উপড়ে ফেলে এবং যে নারী দাঁত কেটে সরু করে দাঁতের মাঝখানে ফাঁকা বানায়, যে কাজগুলি দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে পরিবর্তন সাধিত হয়, এদের উপর আল্লাহ তাআলা অভিশাপ বর্ষণ করুন। আমি কেন তার উপর অভিশাপ বর্ষন করবো না, যাদের উপর আল্লাহর রাসূল অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। সেই সাথে তা আল্লাহ তাআলার কিতাবেই বিদ্যমান আছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৯৪৩, ৫৫৯৯, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-১৪৬৭

তবে হিজড়াদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হলে ভ্রুকে কেঁচি দিয়ে ছোট করা জায়েজ আছে। যেমন ফাতাওয়া শামীতে এসেছে- ولا بأس بأخذ الحاجبين وشعر وجهه ما لم يشبه المخنث (رد المحتار على الدر المختارن كتاب الحظر والاباحة، فصل فى النظر والمس-٦/٣٧٣

হাত-পা ও চেহারার চুল উপড়ে ফেলাঃ মহিলাদের শরীরের অতিরিক্ত লোম ও চুল উপড়ে ফেলা জায়েজ আছে। যেমন দাড়ি মোচ, লোম ইত্যাদি। (قوله والنامصة إلخ) ذكره في الاختيار أيضا وفي المغرب. النم: نتف الشعر ومنه المنماص المنقاش اهـ ولعله محمول على ما إذا فعلته لتتزين للأجانب، وإلا فلو كان في وجهها شعر ينفر زوجها عنها بسببه، ففي تحريم إزالته بعد، لأن الزينة للنساء مطلوبة للتحسين، إلا أن يحمل على ما لا ضرورة إليه لما في نتفه بالمنماص من الإيذاء. وفي تبيين المحارم إزالة الشعر من الوجه حرام إلا إذا نبت للمرأة لحية أو شوارب فلا تحرم إزالته بل تستحب المخنث (رد المحتار على الدر المختارن كتاب الحظر والاباحة، فصل فى النظر والمس-٦/٣٧٣)

বধুসাজঃ

ইতোপূর্বের আলোচনা দ্বারাই একথা বুঝে এসে গেছে যে, সাজগোজ করাতে ইসলামী শরীয়তে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। যদি না কোন হারাম উদ্দেশ্য হয় কিংবা কোন হারাম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে সাজগোজ করাতে কোন সমস্যা নেই। আর স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে সাজগোজ করতে শরীয়ত স্ত্রীকে উদভুদ্ধ করে থাকে। তাই স্বামীর জন্য স্ত্রীকে সাজিয়ে দেয়া বা স্ত্রী নিজেই সাজগোজ করাতে কোন সমস্যা নেই। তবে যদি অন্য কোন শরীয়ত বিরোধী এতে অনুপ্রবেশ করানো হয়, তাহলে ভিন্ন কথা।

শেষ কথা, এক বাক্যে যেমন পার্লারকে নাজায়েজ বলা যাবে না, ঠিক তেমনি এক বাক্যে তাকে জায়েজও বলা যাবে না। উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, হারাম কাজ না করলে পার্লার খোলা জায়েজ আছে, আর হারাম কাজ করা হলে জায়েজ নয়।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১০ মে, ২১