প্রচলিত গণতন্ত্র সম্পর্কে ইসলামের বিধান

ইসলামী জিন্দেগীরাজনীতি২২ ফেব, ২১

প্রশ্ন

গণতন্ত্র একটি কুফুরীতন্ত্র, একথা সর্বস্বীকৃত। সে মতে বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলি যাদের গণতন্ত্রের উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এই ভিত্তিতে তাদেরকে কাফির বলা যাবে কিনা ? এবং সে সমস্ত দলগুলিকে ভোট দেয়া জায়িয হবে কিনা ? যদি ভোট দেয় তাহলে গণতন্ত্রের সমর্থন করার কারণে তাদেরকে কাফির বলা যাবে কিনা ? গণতন্ত্র যে কুফরী ঐ বিষয়ে কুরআন হাদীসের আলোকে প্রমাণ জানতে ইচ্ছুক।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

গণতন্ত্রের দু’টি দিক রয়েছে। গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা, গণতান্ত্রিক কর্মসূচী।

গণতান্ত্রিক চিন্তাধারাঃ

গণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় জনগণকে ক্ষমতার মূল উৎস মনে করা হয়। সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে জনতার যে কোন সিদ্ধান্ত এ মন্ত্র মতে চুড়ান্ত ও অপরিহার্য। এক কথায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে (নাঊযুবিল্লাহ) খোদায়ী ফয়সালার স্থান দেয়া হয়, যার কোন সিদ্ধান্তই অগ্রাহ্য করা যাবে না।

শরী‘আতের দৃষ্টিতে এসব চিন্তাধারা সবই হল কুফরী চিন্তাধারা। যে ব্যক্তি বুঝে শুনে এসবের প্রতি আস্থাশীল হয় তার ঈমান চলে যাওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। অবশ্য কেউ যদি গণতন্ত্রের এসব মূলমন্ত্র না জেনে অপরের দেখাদেখি গণতন্ত্রকে সমর্থন করে তাহলে সে কুফরী তন্ত্রের সমর্থনকারী হিসাবে মারাত্মক গুণাহগার হবে।

পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মূল মন্ত্রগুলো কুফরী হওয়ার প্রমাণ হল যে, এগুলো কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। নিম্নে কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হল।

আল্লাহ পাক কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, ان القوة لله جميعا • “নিশ্চয়ই সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই”। -সূরা বাকারা, ১৬৫ অন্যত্র ইরশাদ ফরমান “ان الحكم الا لله • আল্লাহ তা‘আলাই বিধানদাতা”। -সূরা ইউসুফ, ৪০ অপর আয়াতে ইরশাদ করেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার নিকট ধর্ম একমাত্র ইসলাম”। (সূরা আল ইমরান) আরো ইরশাদ হচ্ছে, وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ • “যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম তালাশ করে (গ্রহণ করে) কস্মিনকালেও তা মেনে নেয়া হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্থ”। -সূরা আল-ইমরান, ৮৫ অন্য আয়াতে ঘোষিত হচ্ছে, وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا • “আল্লাহ ও তার রাসূল কোন বিষয় নির্ধারণ করলে, কোন ঈমানদার নর-নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন মত অবলম্বনের অধিকার নেই। যে আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্যে পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়”। -সূরা আহযাব, ৩৬

গণতান্ত্রিক কর্মসূচীঃ

ক. গণতান্ত্রিক রাজনীতির কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম কর্মসূচি হল ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে দেশের উচ্চ দায়িত্বশীল পদের নির্বাচন।শরী‘আতের দৃষ্টিতে গণভোটের এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ অসার ও অযৌক্তিক। সুতরাং তা নাজায়িয। কুরআনে পাকের বহু আয়াতে এ পদ্ধতির অসারতা প্রমাণ করতঃ বিরোধিতা করা হয়েছে, যার কয়েকটি উল্লেখ করা হলঃ আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ • “আপনি যদি পৃথিবীর অধিকাংশের কথা মেনে নেন, তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দিবে। তারা কেবল অলিক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথা বলে”। -সূরা আল-আনআম, ১১৬ অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ • “তাদের অধিকাংশই শুধু অনুমানের উপর চলে, অথচ অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোন কাজেই আসে না। -সূরা ইউনুস, ৩৬ অপর আয়াতে বলেন, “আপনি বলে দিন, অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয় যদিও অপবিত্রের আধিক্য তোমাকে বিস্মিত করে”। -সূরা মায়েদা, ১০০উক্ত আয়াত সমূহের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, জনগণের অধিকাংশ হবে মূর্খ, বোকা ও দায়িত্বহীন। আর প্রচলিত গণতন্ত্রে এদের অধিকাংশ রায়ের উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সুতরাং তা নিশ্চিতভাবে ভুলই হবে।সুতরাং বাছ-বিচার ছাড়া সংখ্যাধিক্যকে মাপকাঠি বানালে তা সুনিশ্চিতভাবে ভ্রষ্ট হবে। বর্তমানে তাই হচ্ছে। তবে যেহেতু প্রতিনিধি নির্বাচনের উক্ত নাজায়িয পদ্ধতি এদেশ থেকে ইংরেজ বিতারণের সময় ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে কৌশলে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদের প্রচেষ্টা ছাড়া ব্যক্তি বিশেষের জন্য এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল ব্যাপার।সেজন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক না হয়ে শুধু ভোটের সময় প্রার্থীদের মাঝে তুলনামূলক ইসলাম, দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক বা এমন লোকের অবর্তমানে কমপক্ষে অন্যের তুলনায় কম ক্ষতিকর প্রার্থীকে ভোট প্রদান করা জায়িয আছে। এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হল সকল সৎ মানুষেরা ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকলে অসৎ লোকেরা অসৎ প্রার্থীকেই নির্বাচন করে নিবে। তখন সকলেরই অসৎ লোকের ফেতনায় পড়তে হবে। তখন ইসলামের আরো বেশী ক্ষতি হয়ে যাবে।তাছাড়া এ পদ্ধতি ভুল হলেও ভোট প্রদান মূলত সাক্ষ্য প্রদান করা, আর ন্যায়ের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করা জরুরী, তাই উযর ছাড়া যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দান হতে বিরত থাকলে গুনাহ হবে। যারা গণতান্ত্রিক ভোট পদ্ধতিকে ইসলাম সম্মত নয় জেনেও প্রয়োজনের খাতিরে তুলনামূলক সৎ কোন প্রার্থীকে ভোট দেবে তাদেরকে কাফির বা ফাসিক কিছুই বলা যাবে না বরং নিজেরাও এসব ক্ষেত্রে ভোট দান হতে বিরত না হওয়া উচিত।

খ. গণতন্ত্রের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মিছিল, মিটিং, সভা-সেমিনার, প্রচার-বিজ্ঞাপন, বিবৃতি, হরতাল, বয়কট, অনশন, ধর্মঘট, অবরোধ ইত্যাদি।এসবের মধ্য হতে প্রচলিত হরতাল ও মিথ্যা বিবৃতি এবং আমরণ অনশন শরী‘আতের দৃষ্টিতে জায়িয নেই। এছাড়া অন্যসব কর্মসূচি মূলত বৈধ। তবে যদি নিছক দলীয় ও নেতৃত্বের লোভে করা হয় তাহলে তা জায়িয হবে না। তেমনিভাবে কাউকে বা জনগণকে অহেতুক কষ্ট দেওয়া না হয় কিংবা তাদের আর্থিক ক্ষতি করা না হয় বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সম্মতিতে পালন করা হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ জায়িয। বরং যে মুসলমান মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এতে শরীক হবে সে সওয়াবের ভাগী হবে। এক্ষেত্রে সকলের যার যার সাধ্যানুযায়ী সহায়তা বা সমর্থন করা চাই।

- والله اعلم باالصواب -

সূত্র

  • আহসানুল ফাতাওয়া, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৪
  • জাওয়াহিরুল ফিকহ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩৬
  • ফিকহী মাকালাত, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২৮৬

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২২ ফেব, ২১