পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের পার্থক্য

ইসলামী জিন্দেগীনামায২২ ফেব, ২১

প্রশ্ন

নামায আদায়ের ক্ষেত্রে কোন বিষয় আদায় করার পদ্ধতিতে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে ভিন্নতা দেখা যায়। কেউ কেউ বলে থাকে যে, “পুরুষ ও মহিলাদের নামায আদায়ের পদ্ধতি একই রকম। হাদীসে উভয়ের নামায আদায়ের পদ্ধতির কোন পার্থক্য নেই”।

এখন আমার প্রশ্ন হল, পুরুষ ও মহিলার নামায আদায়ের পদ্ধতিতে কোন পার্থক্য আছে কি-না? যদি থাকে তাহলে হাদীসের আলোকে জানিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

শরী‘আতে এমন কিছু হুকুম-আহকাম রয়েছে, যেগুলো পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে সমভাবে আরোপিত হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবয়ান করার নিয়ম-নীতিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে।

কুরআন-হাদীসে মহিলাদের পর্দা করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর এ পর্দায় প্রতি লক্ষ্য করেই আযান, ইকামাত, ইমামতী ও জুম‘আর ও জামা‘আতের নামায ইত্যাদি থেকে মহিলাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

নামায আদায় করার নির্দেশ যদিও পুরুষ ও মহিলা উভয়ের প্রতিই সমভাবে আরোপিত হয়েছে, তথাপি পর্দার প্রতি লক্ষ্য করেই হাদীসে নামাযের কিছু আহকাম বা আরকান আদায় করার পদ্ধতি বা নীতিমালার ব্যাপারে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে কিছু পার্থক্য করা হয়েছে। সুতরাং নিম্নে উদাহরণ স্বরুপ এমন কয়েকটি রুকন বা হুকুমের বর্ণনা উপস্থাপনা করা হল, যে সকল রুকন আদায় করার পদ্ধতি বা নীতিমালার হাদীস ও ফিকহের আলোকে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে।

শরয়ী আহকামের উৎস শুধু কুরআন–হাদীস নয়, বরং কুরআন–হাদীস স্বীকৃত আরো দু’টি উৎস রয়েছে। অন্যথায় শুধু কুরআন দ্বারা পুরুষের নামাযও পরিপূর্ণ ভাবে প্রমাণ করা অসম্ভব। সুতরাং পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের পার্থক্য প্রমাণের বিষয়ে একমাত্র কুরআন বা বুখারী শরীফ এর হাদীসের দাবী তুলে এক শ্রেণীর লোক মূলতঃ কুরআন-হাদীসকে অস্বীকার করে। একথাটি মনে রেখেই নিম্নোক্ত জবাব লক্ষ্য করুন।

(১) তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত উঠানোঃ উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী স্বীয় কর্ণদ্বয় পর্যন্ত উঠাবে। পক্ষান্তরে মহিলাগণ নিজের উভয় হাতের আঙ্গুল উভয় কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছেঃ

হযরত ওয়ায়িল ইবনে হুজর e হতে বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ c তাকে ডেকে বললেন, “হে ইবনে হুজর! যখন তুমি নামায পড়বে তখন তোমার উভয় হাত স্বীয় কান বরাবর উঠাবে। আর মহিলাগণ তাদের হাত কাঁধ বরাবর উঠাবে”।

এ প্রসঙ্গে মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা নামক কিতাবের ১ম খণ্ড, ২৭০ নং পৃষ্ঠার একাধিক তাবেয়ী ফকীহগণ থেকে ফাতাওয়া বিদ্যমান রয়েছে।

তাছাড়া এ ব্যাপারে ফিকাহবিদগণ থেকেও অনুরুপ বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- “যখন কেউ নামাযে প্রবেশ করার ইচ্ছা করবে তখন উভয় হাত স্বীয় কর্ণদ্বয় পর্যন্ত উঠাবে, যেন হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলদ্বয় উভয় কানের বরাবর হয়। আর মহিলাগণ তাঁদের উভয় হাত স্বীয় কাঁধদ্বয় পর্যন্ত উঠাবে। তারপর তাকবীর বলে হাত বাঁধবে। এটাই সঠিক পদ্ধতি।”

(২) হাত বাঁধাঃ পুরুষগণ নাভীর নীচে ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জা ধরে রাখবে। পক্ষান্তরে মহিলাগণ বুকের উপর ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখবে। সুতরাং গ্রহণযোগ্য হাদীসের মাধ্যেমে জানা গেল যে, হযরত রাসূলুল্লাহ c নামাযে নাভীর নীচে হাত বেঁধেছেন। সুতরাং পুরুষদের জন্য নাভীর নীচে হাত বাঁধাই সুন্নাত। কিন্তু মহিলাদের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের ইজমা হয়ে গেছে যে, তাদের বুকের উপর হাত রাখা সুন্নাত।

যেহেতু এ ব্যাপারে উলামায়ে কিরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন, তাই এর উপর অবশ্যই আমল করতে হবে। কারণ, কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইজমার বরখেলাফকারী দোযখী হবে।

(৩) সিজদাঃ সিজদা করার ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে অনেকটা পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- সিজদার সময় পুরুষগণ উভয রান ও পেট পৃথক রাখবে এবং খোলামেলাভাবে সিজদা করবে। তেমনিভাবে উভয় কনুই ভূমি হতে উঁচু করে রাখবে এবং এক অঙ্গ অপর অঙ্গের সাথে মিলিয়ে রাখবে না ইত্যাদি।

পক্ষান্তরে মহিলাগণ পুরুষদের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ মহিলারা সিজদার সময় উভয় রান পৃথক রাখবে না, বরং পেট রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং খুব জড়সড় হয়ে সিজদা করবে, যাতে এক অঙ্গ অপর অঙ্গের সাথে মিলে যায়। এ প্রসঙ্গে নিম্নে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল।

হযরত যায়িদ e হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ c একবার দু’জন মহিলার নিকট নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে বললেন- “যখন তোমরা সিজদা করবে, তখন শরীর যমীনের সাথে মিলাবে। কেননা, সিজদার ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষের মত নয়”।

হযরত আলী e বলেন, মহিলাগণ খুব জড়সড় হয়ে সিজদা করবে এবং সিজদার সময় অবশ্যই পেট উভয় রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে।

হযরত লাইছ i প্রসিদ্ধ তাবেয়ী এবং ফকীহ হযরত মুজাহিদ হতে বর্ণনা করে বলেন, তিনি সিজদায় মহিলাদের ন্যায় পুরুষের পেট উভয় রানের উপর রাখাকে মাকরূহ মনে করতেন।

হযরত ইবরাহীম e হতে বর্ণিত রয়েছে যে, মহিলারা সিজদা করার সময় পেটকে অবশ্যই রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং নিতম্ব উঁচু করবে না এবং পুরুষদের মত খোলামেলাভাবে সিজদা করবে না।

উপরোল্লেখিত হাদীস ও -সা-বে সাহাবা সমূহের লোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সিজদার ক্ষেত্রে এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলোতে পুরুষ ও মহিলাদের বিধান এক নয়, বরং ভিন্নতর।

(৪) দুই সিজদার মাঝে ও তাশাহহুদের সময় বসার পদ্ধতিঃ এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, পুরুষরা নামাযে বাম পায়ের উপর বসবে এবং ডান পা খাড়া রাখবে। কিন্তু এক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ তারা নিতম্বের উপর বসবে এবং উভয় পা ডান দিকে বের করে কিবলামুখী করে রাখবে। যেমন, হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

হযরত ইবনে উমর e -কে জিজ্ঞাসা করা হল, হযরত রাসূলুল্লাহ c -এর যুগে মহিলারা কিভাবে নামায পড়তেন? উত্তরে তিনি বললেন, মহিলারা নিতম্বের উপর বসতেন এবং তাদেরকে জড়সড় হয়ে সিজদা করা ও বসার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

হাদীসের আলোকে নামাযের উপরোল্লেখিত কয়েকটি বিষয় আলোচনা করার দ্বারা একথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টরুপে জানা গেল যে, নামাযের অনেক বিষয়ই এমন রয়েছে, যেগুলো আদায় করার পদ্ধতিতে পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং যারা হাদীসের কিতাব অধ্যয়ন না করে বা হাদীস না বুঝে বলে বেড়ায় যে, হাদীসে পুরুষ ও মহিলাদের নামায আদায় করার ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই, আশা করি তারা উপরোল্লিখিত আলোচনা পাঠ করার পর এ ধরনের মনগড়া বাক্য উচ্চারণ করতে আর প্রয়াস পাবে না।

- والله اعلم باالصواب -

সূত্র

  • ই’লাউস সুনাম, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৫৬
  • জামিউল মাসানীদ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৪০০
  • ই’লাউস সুনাম, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ২০
  • মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩০৩
  • মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইব, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩০২
  • সিআয়াহ, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১,১৫৬
  • মাজমূ’আয়ে রাসায়িল, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৩০৭
  • ই’লাউস সুনাম, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ১৯

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২২ ফেব, ২১