দীর্ঘকালীন ভাড়া চুক্তি করে মোটা অংকের অর্থ গ্রহণ বৈধ কি না

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসভাড়া-লিজ৯ মে, ২১

প্রশ্ন

আমাদের এলাকার পূর্ব পরিচিত এক বাড়িওয়ালার সাথে আমি একটি দীর্ঘকালীন ভাড়াটিয়া চুক্তি করেছি ১০ বছরের জন্য। ভাড়াটিয়া চুক্তিটি এভাবে হয়েছে যে, আমি বাড়িওয়ালাকে ভাড়ার জন্য অগ্রিম একত্রে ১০ লক্ষ টাকা নগদ প্রদান করি এবং এর বিনিময়ে বাড়িওয়ালা তার বাসার একটি ইউনিট আমাকে আগামী ১০ বছরের জন্য ভাড়া দিতে সম্মত হন এই শর্তে যে, আমি তাকে মাসিক ১০০০ টাকা জমিদারী ভাড়া প্রদান করব কারণ এটা নাকি জমিদারী ভাড়া হিসেবে দিতে হবে অন্যথায় আমাদের চুক্তি নাকি সুদের কারবার বলে গণ্য হবে এবং আগামী ১০ বছরে এ ভাড়া মাসিক ১০০০ টাকাই থাকবে অর্থাৎ কম-বেশি হবে না। এছাড়া গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদি খরচ ব্যবহারের ভিত্তিতে যত আসে সেটা আমি প্রদান করব এবং আমাকে আর কোনো মাসিক ভাড়া তাকে দিতে হবেনা। চুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত এটাও রয়েছে যে, আগামী ১০ বছর পরে যখন এই চুক্তি শেষ হবে তখন বাড়িওয়ালা আমাকে এই ১০ লক্ষ টাকা পুরোটাই ক্যাশ ফেরত দিবে যেটা আমি ভাড়া নেয়ার সময় ক্যাশ প্রদান করেছিলাম। চুক্তি চলাকালীন বাড়িওয়ালাও আমাকে বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য বলতে পারবেন না এবং আমিও চুক্তি শেষ হওয়ার আগে বাসা ছাড়তে পারবো না কিংবা আমার দেয়া ১০ লক্ষ টাকাও ফেরত দেয়ার জন্য চাপ দিতে পারবো না তবে যদি একান্ত কোনো সমস্যা আসে তখন সাক্ষীদের তলব করে মাশোয়ারার মাধ্যমে এটা সমাধান করা হবে। পরিচিত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আমাদের সাথে ভাড়াটিয়ার এই চুক্তিটি শুরু হয়েছে ২০১২ এর মার্চ থেকে এবং এটা শেষ হবে ২০২২ এর মার্চ মাসে ইনশাআল্লাহ। গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদির বিল ছাড়াই এই বাসাটির বর্তমানে মাসিক ভাড়া ১৪,০০০ টাকার মত আসে। যেহেতু বড় অংকের টাকা ভাড়ার জন্য অগ্রিম প্রদান করেছি, সেহেতু চুক্তি অনুসারে আমাকে শুধু মাসিক ভাড়া ১০০০ টাকা দিতে হচ্ছে। যদিও নিয়ত ছিলো আমি পরিবার নিয়ে এই বাসায় থাকবো কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে সেই বাসায় আমি উঠিনি এবং এটা এখন অন্যজনকে ভাড়া দেয়া হয়েছে। সেই ভাড়ার টাকা পুরোটাই আমি পাচ্ছি তবে মাসিক ১০০০ টাকা দিতে হচ্ছে বাড়িওয়ালাকে জমিদারী ভাড়া হিসেবে। আরেকটি তথ্য আপনাকে দিতে চাচ্ছি যে, বাড়িওয়ালা আমার এই টাকাসহ আরো কিছু টাকা অন্যদের থেকে ধার নিয়ে তার বাসা তিন তলা থেকে পাচতলা করেছে এবং সে পাচতলা থেকে মাসিক যা ভাড়া পাচ্ছে সেটা জমাচ্ছে যেন ১০ বছর পরে আমাকে সেই ১০ লক্ষ টাকা ক্যাশ ফেরত দিতে তার সমস্যা না হয়। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের এই চুক্তিটি শরীআর আলোকে কি হালাল বলে গ্রহনযোগ্য হয়েছে? যদি হারাম বলে গন্য হয় তবে কোন কোন শর্ত পরিবর্তন করলে হালাল ভাবে এই চুক্তিটি করা যাবে? অর্থাৎ মাসিক ১০০০ টাকা বাদ দিয়েও যে আমি ১৩০০০ টাকা পাচ্ছি এই টাকা আমার জন্য হালাল ইনকাম বলে গন্য হচ্ছে তো? জমিদারী ভাড়ার বিষয়টি কি সঠিক হয়েছে? আপাতত মাসিক ১৩০০০ টাকার পুরোটাই আমি পরিবারের জন্য খরচ করছি কিন্তু যেহেতু ১০ লক্ষ টাকা আমি বাড়িওয়ালাকে অগ্রিম প্রদান করেছি এবং সেটা আমি ১০ বছর পরে ফেরত পারবো সেহেতু আমাকে কি এখন প্রতি বছর এই মূল ১০ লক্ষ টাকার উপরে কোনো যাকাত দিতে হবে নাকি বাড়িওয়ালাকে দিতে হবে? শরীআর আলোকে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে উত্তর প্রদান করে আমাকে দ্বীনের উপর সঠিকভাবে আমল করার সুযোগ প্রদানে আপনাদের সুমর্জি ও দোয়া কামনা করছি। সংযোজন সেই বাসাটি থেকে বর্তমানে আমি ১৪,০০০ টাকা মাসিক ভাড়া পাচ্ছি এবং এর থেকে ১,০০০ টাকা বাড়িওয়ালাকে জমিদারী ভাড়া হিসেবে দেয়ার পর ১৩,০০০ টাকা হয়।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

আপনার প্রশ্নটিতে মূলত দু’টি অংশ। যথা-

১. আপনার কৃত ভাড়া চুক্তিটি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সহীহ হয়েছে কি না?

২. ভাড়াকৃত বাসাটি আপনি ভাড়া দিয়ে যে অর্থ পাচ্ছেন সেটি আপনার জন্য বৈধ কি না?

১. আসলে আপনি যে পদ্ধতি ও নীতিটির কথা উল্লেখ করেছেন, সেটির মাঝে খানিক পরিবর্তন সাধন করলে উক্ত চুক্তিনামাটি জায়েজ হয়ে যাবে। তা হল, আপনারা ভাড়া চুক্তির সময় বলবেন, উক্ত বাসাটির মাসিক ভাড়া হচ্ছে ১,০০০/= (এক হাজার টাকা)। তারপর অগ্রীম বেশ কিছু মাসের ভাড়া প্রদান করা হবে বাড়িওয়ালাকে। যেমন আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত ১০ লাখ টাকা অগ্রীম ভাড়া হিসেবে প্রদান করা হবে। চুক্তিনামায় উল্লেখ থাকবে যে, যখন ভাড়াটিয়া উক্ত বাড়ি থেকে চলে যাবে, তখন যদি অগ্রীম প্রদেয় ভাড়ার টাকা বাকি থাকে, তাহলে তা ফেরত দিয়ে দেবে বাড়িওয়ালা। আর ১০ বছর আগে ভাড়াটিয়া উক্ত স্থান থেকে চলে যেতে পারবে না। যদি চলে যেতে চায়, তাহলে বাড়িওয়ালার সদয় সম্মতি থাকা আবশ্যক। উক্ত চুক্তি সম্পাদনের পর প্রতি মাসে উক্ত ১০ লাখ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা করে ভাড়া হিসেবে কর্তিত হতে থাকবে। তারপর ১০ বছর পর যখন ভাড়া চুক্তি শেষ করার ইচ্ছে করা হবে, তখন ১০ বছরের প্রতি মাসের ১হাজার টাকা করে বাদ দেয়ার পর যত টাকা বাকি থাকবে তত টাকা বাড়িওয়ালা আপনাকে প্রদান করবে। এমনভাবে লেনদেন ও চুক্তি সম্পাদন করলে আপনাদের মাঝের করা চুক্তিটি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধতা পাবে। আর যেহেতু উক্ত ১০ লাখ টাকা ভাড়া হিসেবে বাড়িওয়ালাকে প্রদান করা হয়েছে। তাই এর মালিকানা বাড়িওয়ালার। ভাড়াটিয়া তথা আপনার নয়। তাই এ টাকার যাকাত আপনার উপর আবশ্যক হবে না। বাড়িওয়ালার উপর আবশ্যক হবে। -জাদীদ মুআমালাত কি শরয়ী আহকাম, ১/২২২, মালে হারাম আওর উসকে মাসারেফ ওয়া আহকাম, ৮৪- ৮৬, জাদীদ ফিক্বহী মাসায়েল, ১/১৪৭-১৪৮

২. এক্ষেত্রে আপনার জন্য প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ ১৪ হাজার টাকা গ্রহণ জায়েজ হচ্ছে না। কারণ কোন বাসা ভাড়া নেয়ার পর আরেকজনের কাছে ভাড়া দিতে হলে প্রথমে যে টাকায় ভাড়া নেয়া হয়েছে কেবল সেই টাকায় বা এর চেয়ে কম টাকায় আরেকজনকে ভাড়া দেয়া যায়, এর চেয়ে বেশি টাকায় ভাড়া দিলে তা জায়েজ হয় না। এক্ষেত্রে আপনি যদি উক্ত ভাড়া নেয়াটি জায়েজ করতে চান, তাহলে আপনাকে উক্ত ভাড়াকৃত বাসায় নতুন কোন কিছু সংযোজন করতে হবে, যা বাড়ির মালিকের কাছ থেকে উক্ত বাসা ভাড়া নেয়ার সময় উক্ত বাসায় ছিল না। যেমন বাসায় গ্যাসের সুবিধা ছিল না। আপনি গ্যাস সংযোগ করে দিলেন। বাসায় বিদ্যুৎ সুবিধা ছিল না, আপনি বিদ্যুৎ সুবিধা করে দিলেন। কিংবা বাসায় এসি সিষ্টেম ছিল না আপনি এসি সিষ্টেম করে দিলেন। বাসায় কমোড সিষ্টেম ছিল না, আপনি সংযোজন করে দিলেন, বা বাসায় অগ্নি নির্বাপক পদ্ধতি ছিল না, আপনি সংযোজন করে দিলেন। মোটকথা, প্রথম ভাড়া নেয়ার সময় বাসাটি যে অবস্থায় ছিল, তার চেয়ে যদি কিছু সুবিধা বাড়ানো হয়, চাই তা অতি সামান্যই হোক, তাহলে আপনার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা জায়েজ আছে। যেমন এখানে আপনার প্রতি মাসের ভাড়া হচ্ছে ১হাজার টাকা। আর আপনি যাকে ভাড়া দিচ্ছেন তার কাছ থেকে নিচ্ছেন ১৩ হাজার টাকা। এ ১৩ হাজার টাকা নেয়া আপনার জন্য বৈধ হবে যদি আপনি উক্ত বাসায় কিছুটা পরিবর্তন সাধন করেন। যদি প্রথম ভাড়া নেয়ার সময় বাসার যে অবস্থা ছিল হুবহু সেই অবস্থাই থাকে, তাহলে আপনার জন্য আপনার আদায়কৃত ভাড়ার তুলনায় দ্বিতীয় ভাড়াটিয়া থেকে বেশি নেয়া জায়েজ হবে না। যদি ভাড়াকৃত বাসাটিতে কিছু সুবিধা সংযোজন করে বেশি ভাড়া নেয়া নতুন ভাড়াটিয়া থেকে তাহলে জায়েজ হবে। -ফাতাওয়া বায়্যিনাত, ৪/২৫২-২৫৩

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ৯ মে, ২১