দারুল ইসলাম, দারুল হরব কাকে বলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান কি দারুল ইসলাম ভারত কি দারুল হরব

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসবিবিধ১২ জানু, ২২

প্রশ্ন

দারুল ইসলাম, দারুল হরব কাকে বলে? বাংলাদেশ, পাকিস্তান কি দারুল ইসলাম? ভারত কি দারুল হরব? বিস্তারিত দলীলের আলোকে জানালে ভাল হয়।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

দারুল ইসলাম কাকে বলে? এ বিষয়টি সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হলে প্রথমেই আমাদের রাসূল c এর জমানাটি সামনে রাখতে হবে। রাসূল c এর জমানায় মৌলিকভাবে তিনটি এলাকা ছিল। যথা- ১-মক্কা। ২-মদীনা। ৩-হাবশা বা আবিসিনিয়া। মক্কার হালাত মক্কার হালাত আমাদের কাছে স্পষ্ট। এখানে মুসলমানদের সামান্যতম স্বাধীনতা ছিল না। প্রকাশ্যে ইসলামের কোন বিধান পালনের সুযোগ ছিল না। তাই এটি দারুল হরব। মদীনার হালাত মদীনায় সর্ব প্রকার ইসলামী বিধান পালনের পরিবেশ ছিল। যদিও সেখানে বিধর্মী বেশ কিছু লোক ছিল। কিন্তু তারা সবাই মুসলমানদের অনুগত ছিল। মুসলমানদের সাথে বিদ্রোহ করার মত ক্ষমতা তাদের ছিল না। সুতরাং সুনিশ্চিতভাবে তা ছিল দারুল ইসলাম। হাবশার হালাত খৃষ্টান বাদশা নাজ্জাশীর শাসনাধীন হাবশা তথা আবিসিনিয়া ছিল দারুল আমান। আবিসিনিয়া যদিও খৃষ্টান বাদশার শাসনাধীন, কিন্তু সেখানে মুসলমানরা হিজরত করে স্বাধীনভাবে স্বীয় ধর্ম পালন করতে পারতো। তাদের ধর্ম পালনে কোন বাঁধা দেয়া হতো না। সেই সাথে স্বীয় ধর্ম প্রচারেও কোন বাঁধা ছিল না। তবে ইসলামী শরীয়তের নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান প্রয়োগ করার সুযোগ ছিল না। সুতরাং আবিসিনিয়া ছিল দারুল আমান। দারুল ইসলাম ও নয়, আবার দারুল হরবও নয়। এবার আমরা খুব সহজেই বুঝে নিতে পারবো যে, স্বাভাবিকভাবে সমগ্র পৃথিবীতে দার তথা রাষ্ট্র তিন প্রকার। যথা- ১-দারুল ইসলাম। ২-দারুল হরব। ৩-দারুল আমান। দারুল ইসলাম ও দারুল হরব কাকে বলে? দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সংজ্ঞা ফুক্বাহায়ে কেরাম করেছেন। কিছু মতভিন্নতাসহ প্রায় সকলের সংজ্ঞাই কাছাকাছি পর্যায়ের। ইমাম আবু হানীফা i দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের সংজ্ঞা করতে গিয়ে লিখেছেনঃ قَوْلِ أَبِي حَنِيفَةَ – رَحِمَهُ اللَّهُ – أَنَّ الْمَقْصُودَ مِنْ إضَافَةِ الدَّارِ إلَى الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ لَيْسَ هُوَ عَيْنَ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ، وَإِنَّمَا الْمَقْصُودُ هُوَ الْأَمْنُ وَالْخَوْفُ. وَمَعْنَاهُ أَنَّ الْأَمَانَ إنْ كَانَ لِلْمُسْلِمِينَ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْإِسْلَامِ، وَإِنْ كَانَ الْأَمَانُ فِيهَا لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْمُسْلِمِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْكُفْرِ ইমাম আবু হানীফা i এর বক্তব্য অনুপাতে দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের প্রতি নিসবতের মূল উদ্দেশ্য তা পরিপূর্ণ ইসলামও পরিপূর্ণ কুফর হওয়া নয়। বরং উদ্দেশ্য হল নিরাপত্তা ও ভয় বিষয়ে। অর্থাৎ যদি সর্বদিক থেকে নিরাপত্তা থাকে মুসলমানদের আর স্বাভাবিকভাবে আতংকিত থাকে কুফরী শক্তি, তাহলে সেটি দারুল ইসলাম। পক্ষান্তরে সর্বদিক থেকে নিরাপদ থাকে কুফরী শক্তি আর ভীত থাকে মুসলিমগণ, তাহলে উক্ত রাষ্ট্র দারুল কুফর বা দারুল হরব। -বাদায়েউস সানায়ে-৭/১৩১ আর ইমাম আবু ইউসুফ i এবং ইমাম মুহাম্মদ i দারুল ইসলাম ও দারুল কুফরের সংজ্ঞা করতে গিয়ে লিখেছেনঃ وَقَالَ أَبُو يُوسُفَ وَمُحَمَّدٌ – رَحِمَهُمَا اللَّهُ: إنَّهَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا. (وَجْهُ) قَوْلِهِمَا أَنَّ قَوْلَنَا دَارُ الْإِسْلَامِ وَدَارُ الْكُفْرِ إضَافَةُ دَارٍ إلَى الْإِسْلَامِ وَإِلَى الْكُفْرِ، وَإِنَّمَا تُضَافُ الدَّارُ إلَى الْإِسْلَامِ أَوْ إلَى الْكُفْرِ لِظُهُورِ الْإِسْلَامِ أَوْ الْكُفْرِ فِيهَا، ইমাম আবু ইউসুফ i ও ইমাম মুহাম্মদ i বলেন, দারুল হরব সাব্যস্ত হবে তাতে কুফরী বিধান প্রয়োগ হওয়া হিসেবে। সাহাবাইনের বক্তব্যের সারমর্ম হল, দারুল ইসলাম ও দারুল কুফরের নিসবতের মৌলিকত্ব হল ইসলাম ও কুফরের দিকে নিসবত সংক্রান্ত। অর্থাৎ দারুল ইসলাম বলা হবে যাতে ইসলামী বিধান প্রয়োগ করা হয়, আর দারুল কুফর বলা হবে যাতে কুফরী বিধান প্রয়োগ হয়।

1. দারুল ইসলামে ইসলামী শরীয়তের যাবতীয় ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় বিধান কার্যকর করা হবে।

2. দারুল হরব থেকে যারা হিজরত করে আসবে তাদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থাকরণ।

3. দারুল হরবে আটকে যাওয়া মজলুম মুসলমানদের জন্য সহযোগিতা করা।

4. জিহাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকরণ। দারুল হরবের বিধান

1. এখানে ইসলামী শরীয়তের শাস্তি বিধান কার্যকর হবে না।

2. দারুল হরবে যদি দুই মুসলমানের মাঝেও কোন বিবাদ হয়ে যায়, তাহলে এর সমাধান দারুল ইসলামের বিচারক করবে না।

3. দারুল হরবের বাসিন্দার কাছে অস্ত্র বিক্রি জায়েজ নয়।

4. দারুল হরবের কোন বাসিন্দাকে দারুল ইসলামে এক বছরের চেয়ে বেশি সময়ের জন্য অবস্থানের জন্য অনুমতি দেয়া হবে না। তবে যদি দারুল হরবের বাসিন্দা দারুল ইসলামে অভিবাসী হওয়ার আবেদন করে থাকে তবে ভিন্ন কথা। নিরাপদ ব্যক্তি মনে হলে অনুমতি দেয়া যাবে।

5. দারুল ইসলাম থেকে দারুল হরবে এমন কোন তথ্য বা সম্পদ রপ্তানী করা যাবে না, যার দ্বারা দারুল হরবের রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি পায়। চাই তা টেকনোলজী বিষয়ক বা খনিজ সম্পদ হোক বা অন্য কিছু।

6. দারুল হরবের বাসিন্দাদের উপর আবশ্যক হল, তারা সে দেশ থেকে হিজরত করে নিরাপদ দেশে চলে যাবে।

7. দারুল হরবের আহলে কিতাব তথা ইহুদী খৃষ্টান মেয়ের সাথে বিবাহ করা মাকরূহ।

8. মুসলিম স্বামী স্ত্রীর মাঝে যদি একজন দারুল ইসলাম ছেড়ে দারুল হরবে চলে যায়, এবং সেখানেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, তাহলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।

9. দারুল হরবের মাঝে যদি কাফের স্বামী স্ত্রীর মাঝে একজন মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে দারুল ইসলামের মত অপরজনের কাছে ইসলাম পেশ করার দরকার নেই। এমনিতেই ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে স্বামী স্ত্রী আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু দারুল ইসলামে এমনটি হলে অপরজনের কাছে ইসলাম পেশ করা হবে, যদি অপরজন ইসলাম গ্রহণ করে নেয়, তাহলে বিবাহ বহাল থাকবে, গ্রহণ না করলে বিবাহ ভেঙ্গে যাবে। ১০- ভিসা নিয়ে দারুল ইসলাম থেকে যদি কোন মুসলিম দারুল হরবে ব্যবসা করতে যায়, তাহলে তার জন্য ইসলামী ব্যবসা নীতি পরিপূর্ণ রক্ষা করা জরুরী নয়। তবে ধোঁকা ও প্রতারণা করা করা যাবে না। ১১- বুনিয়াদী ও মূলনীতিগতভাবে দারুল হরবের বাসিন্দার জান-মাল অরক্ষিত বলে সাব্যস্ত হবে। যদিও সে মুসলমান হোক না কেন। অর্থাৎ কোন কারণে মুসলমান কর্তৃক দারুল হরবের কেউ মারা গেলে এর রক্তপণ দেয়া মুসলমানের উপর আবশ্যক হবে না ইসলামী বিধান অনুপাতে। ১২- দারুল হরবে বসবাসকারী মুসলমানের জন্য অনেক বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা উজর বলে সাব্যস্ত হবে, যা দারুল ইসলামের বাসিন্দার জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন হজ্ব করা ফরজ একথা যদি দারুল হরবের মুসলিম বাসিন্দা না জানে, তাহলে হজ্ব আদায় না করার গোনাহ তার হবে না। কিন্তু দারুল ইসলামের বাসিন্দা না জানার কারণেও গোনাহগার হবে। কারণ তার জন্য আবশ্যক দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়গুলো জেনে নেয়া। ১৩- দারুল ইসলামে থাকা ব্যক্তির জন্য দারুল হরবে অবস্থানকারী আত্মীয়ের খোরপোষ দেয়া আবশ্যক নয়। ১৪- দারুল ইসলামের কেউ দারুল হরবের কারো জন্য ওসিয়ত করলে তা কার্যকর হবে না। ১৫- দারুল ইসলামের কোন বাসিন্দার জন্য দারুল হরবের বাসিন্দার জন্য কোন কিছু ওয়াকফ করলে তা কার্যকর হবে না। ১৬- দারুল হরবের কেউ দারুল ইসলামের বাসিন্দা কারো থেকে মিরাস তথা উত্তারাধিকার সম্পত্তি পাবে না। উল্লেখিত বিধানের সারমর্ম হল-

1. দারুল হরবের বিধান দারুল ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত।

2. দারুল হরবের বাসিন্দারা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, যুদ্ধে লিপ্ত, তাই তাদের জান-মালের ক্ষতি সাধন করা মৌলিকভাবে জায়েজ।

3. যেহেতু দারুল হরবের মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নেই, তাই তাদের জন্য দ্বীনের অনেক বিষয় সম্পর্কে জানা সম্ভপর হয়ে উঠবে না। তাই তাদের জন্য না জানা উজর বলে সাব্যস্ত হবে। কিন্তু দারুল ইসলামের ক্ষেত্রে তা উজর বলে সাব্যস্ত হবে না। দারুল আমানের বিধান দারুল আমান সরাসরি যেমন দারুল ইসলাম নয়। আবার ইসলাম বিদ্বেষী দারুল হরবও নয়। তাই এতে পরিপূর্ণভাবে ইসলামী বিধান যেমন প্রয়োগ করা যাবে না, ঠিক তেমনি দারুল হরবের কঠোরতাও এর মাঝে নেই। কারণ দারুল আমানে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করতে সক্ষম। ধর্ম প্রচারেও রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। তাই দারুল ইসলাম এবং দারুল হরবের বিধানের মাঝামাঝি পর্যায়ের হবে দারুল আমানের বিধান।

1. দারুল আমানে ইসলামী শরীয়তের শাস্তি-বিধান প্রয়োগ হবে না।

2. দারুল আমানের মুসলমানদের বিষয়-আশয়ের ফায়সালা দারুল ইসলামের আদালতে হবে না।

3. দারুল আমানের বাসিন্দাদের উপর হিজরত করা আবশ্যক নয়।

4. দারুল আমান রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে মুসলমানদের প্রচেষ্টা করা জায়েজ আছে। যেমন সাহাবায়ে কেরাম আবিসিনিয়ার বাদশাকে সাহায্য করেছেন তার দুশমনদের বিরুদ্ধে। তবে শর্ত হল, রাষ্ট্রপক্ষ যেন কোন মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের কার্যকলাপে লিপ্ত না হয়।

5. শরয়ী বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা যেমন দারুল হরবের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে মাজুর মনে করা হয়, তেমন দারুল আমানের বাসিন্দাদের মনে করা হবে না। অর্থাৎ শরয়ী বিধান না জানা তাদের জন্য কোন উজর বলে সাব্যস্ত হবে না। সকলের জন্য শরয়ী বিধান জানা জরুরী।

6. স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে একজন দারুল আমান ছেড়ে দারুল ইসলামে চলে গেলে দেশ ভিন্ন হওয়ার কারণে স্বামী ও স্ত্রীর বন্ধন নষ্ট হবে না। বরং বহাল থাকবে।

7. দারুল আমানে কোন মুসলিম বা অমুসলিমের সাথে গায়রে শরয়ী লেনদেন জায়েজ নয়। যেমন দারুল ইসলামে বৈধ নয়।

8. দারুল আমানে বসবাসকারী ব্যক্তিগণ দারুল ইসলামের আত্মীয় থেকে মিরাস পাবে, খোরপোষ সবই পাবে। তাদের পরস্পরের জন্য ওসিয়ত করা জায়েজ আছে। -কামুসুল ফিক্বহ-৩/৩৯৫-৪০৪ বিস্তারিত জানতে পড়–ন- ফাতাওয়া মাহমুদিয়া-২০/৩৫৪-৩৭৩।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১২ জানু, ২২