তাকদীরের উপর নির্ভর করে আমল ছেড়ে দেয়া

ইসলামী জিন্দেগীআকীদা১৩ ফেব, ২১

প্রশ্ন

উলামায়ে কেরামের বয়ানে শুনেছি যে, আল্লাহ তা’আলার দরবারে দু’টি কিতাব বাদফতর আছে। তার একটির মধ্যে শুধু জান্নাতীদের নাম আছে। আর অপরটির মধ্যে আছেকেবলমাত্র জাহান্নামীদের নাম । উভয় খাতায় নাম গুলো যোগ করে টোটাল সংখ্যানির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে কোন হের ফের বা কম বেশ হবে না। তাহলে প্রশ্ন হয় যে, সব কিছু যদি আগেই নিদির্ষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকষ্ট করে আর আমল করার প্রয়োজন কি? তাছাড়া আমল করেই বা লাভ কি? ফয়সালা তোআগেই হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে একটু খুলে বলার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।কারণ, এ ব্যাপারে আমি খুবই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝে আছি।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

আপনি যে হাদীসটি শুনেছেন, তা সহীহ ও সঠিক। হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে উক্ত হাদীসটি বর্ণিত আছে। তবে উল্লেখিত হাদীসটি নিয়ে নিজের জ্ঞান-বু্দ্ধি দ্বারা গবেষণা করা উচিৎ নয়। কারণ, তাকদীরের ব্যাপারে নিজের আকল-বুদ্ধি দ্বারা গবেষণা করা বা তর্ক- বিতর্কে লিপ্ত হওয়া অথবা বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা শরীয়তে নিষেধ। একথা ঠিক, আল্লাহ্ তা'আলা তার পরিপূর্ণ জ্ঞান ও ইলমের দ্বারা লিখে রেখেছেন যে, কোন বান্দা নিজের ইখতিয়ার অনুযায়ী আমল করে জান্নাতের বাসিন্দা হবে, আর কোন বান্দা হবে জাহান্নামের বাসিন্দা। তবে তিনি এরূপ কেন লিখে রেখেছেন তা তিনিই জানেন। এর মধ্যে অনেক হিকমত নিহিত রয়েছে। আমাদের শুধু এতটুকু জানতে হবে যে, এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় কি? এর চেয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়।

এ ব্যাপারে বান্দার যিম্মাদারী হলো, আল্লাহ্ তা'আলার এই ফয়সালার উপর ঈমান আনা এবং বাস্তবিক পক্ষে যে দুটি কিতাব তৈরী আছে, তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা। এতটুকু করলে আমাদের দায়িত্ব আদায় হয়ে গেল। এর উপর ভিত্তি করে আমল না করা বা বিভিন্ন প্রশ্ন উথ্থাপন করা আমাদের দায়িত্ব বহির্ভূত বা অনধিকার চর্চার শামিল। সারকথা, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, উক্ত দুই ব্যাপারে বান্দার যিম্মাদারী কিতাবের উপর ঈমান রাখা এবং নিজের ইখতিয়ার দ্বারা আল্লাহর হুকুম আহকাম ও বিধি নিষেধ বাস্তবায়ন করা। কারণ, উক্ত কিতাবদ্বয়ে কি লেখা আছে, তা আমাদের জানা নেই। তাছাড়া সেই লেখা দ্বারা আমাদের ইখতিয়ার ও শক্তি তো নষ্ট হয়ে যায়নি। সুতরাং কিতাবে যাই লেখা থাকুক, আমাদের আমল করে যেতে হবে এটাই বান্দার বান্দেগী ও তার দায়িত্ব। আর এরই মধ্যে তার সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। উক্ত হাদীস শুনে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন স্বয়ং সাহাবায়ে কিরাম (রাযিঃ)ও একই প্রশ্ন করেছিলেন। জওয়াবে নবী c তাঁদেরকে কিতাবের উপর ভরসা করে বসে না থেকে আমল করতে বলেছিলেন। কারণ, আমলই বান্দার ইখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।

উক্ত কিতাবে দুটি সম্পর্কে একটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে। আশা করা যায় এর দ্বারা বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন, একজন ন্যায়পরায়ণ মুসলিম বাদশাহের দরবারে বিভিন্ন লোকের যাতায়াত ও যোগাযোগ আছে। কেউ বাদশাহকে দ্বীনী ব্যাপারে সহযোগিতা করতে আসেন এবং তার দ্বীনদারীর কারণে তাকে মুহাব্বত ও শ্রদ্ধা করেন। আবার অনেকে নিজের হীন স্বার্থ আদায়ের জন্য বাদশাহের প্রতি বাহ্যতঃ মুহাব্বত প্রদর্শন করেন। এক সময় বাদশাহ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যেম প্রকৃত বাদশাহ প্রেমীদের পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু সমস্যা হলো নকল মুহাব্বতকারীগণ দুর্নাম রটাবেন যে, বাদশাহ মহোদয় আমাদের প্রতি ইনসাফ করলেন না। বাস্তবে আমরাও তাকে ভালবাসি। কিন্তু তিনি আমাদেরকে পুরস্কান না দিয়ে অন্যদেরকে দিলেন। এ সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য বাদশাহ একটা হিকমত অবলম্বন করলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন যে, আমার দরবারে দুটি দফতর তৈরী করা হয়েছে। ১ম দফতরে যাদের নাম এসেছে, তাদেরকে নির্দিষ্ট তারিখে আমি পুরস্কৃত করব। আর ২য় দফতরে যাদের নাম এসেছে তাদেরকে নির্দিষ্ট তারিখে আমি শাস্তি প্রদান করব এবং উভয় দফতর চূড়াস্ত করে শেষে টোটাল লাগানো হয়েছে। সুতরাং এর মধ্যে পরিবর্তনের কোনা সুযোগ নেই। বাদশাহের এ ঘোষণার পর প্রকৃত বাদশাহ প্রেমীগণ তাদের আচার-আচরণ ও দরবারে যাতায়াতের মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন করবেন না। তারা বললেন যে, আমরা আল্লাহর সস্তষ্টির জন্য এই আল্লাহওয়ালা বাদশাহকে মুহাব্বত করেছি এবং তার কাজে সহযোগিতা করেছি। সুতরাং আমরা নেক কাজ করেই যাব। চাই বাদশাহ আমাদেরকে পুরস্কৃত করুন বা শাস্তি প্রদান করুন। এটা বাদশাহের নিজস্ব ব্যাপার।

আর স্বার্থান্বেষী মহল বাদশাহের ঘোষণার পরে বাদশাহের দরবারে আসা- যাওয়া ও সহযোগিতা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিল। তারা বলতে লাগল যে, দু’টি দফতর যখন তৈরী হয়ে গেছে, তাহলে এখন দরবারে যাতায়াত বৃথা। কারণ, প্রথম দফতরে নাম থাকলে সর্বাবস্থায় পুরস্কার পাওয়া যাবে। সুতরাং দরবারে যাওয়া না যাওয়ার সাথে কোন পার্থক্য নেই। তেমনি ভাবে যদি দ্বিতীয় দফতরে নাম থাকে, তাহলে শাস্তি তো নিশ্চিত। কাজেই দরবারে গিয়ে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজ করাই ভালো।

এরপরে নির্দিষ্ট তারিখে দেখা গেল যে, যারা দফতরের উপর ভরসা করে যাতায়াত বন্ধ করেছিলে তারা তাদের অপরাধের শাস্তি পেয়েছে। আর যারা তাদের খালেস মুহাব্বতের কারণে পুরস্কৃত হয়েছেন। এটা হলো উপরোক্ত বিষয়ের এটি উদাহরণ। এর উপর ভিত্তি করে আমরা আল্লাহ তা‘আলার দুই কিতাবের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহ তা’আলা রূহের জগতে প্রথম যখন সকলকে জমা করেছলেন, তখনই নিজের ইলম মুতাবিক এক দলকে জান্নাতে, আরেক দলকে জাহান্নামে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এমতাবস্থায় কাফির-মুশরিকদের আল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযোগের সুযোগ থাকতো যে, আল্লাহ আমাদের সেই দুনিয়ায় পাঠিয়ে আমল করার সুযোগ দিলে আমরা অন্যদের থেকে বেশী আমল করতাম। কিস্তু আল্লাহ তো আমাদেরকে সুযোগই দিলেন না। কাজেই আল্লাহ তা’আলা তার ইলম দ্বারা ফয়সালা না করে সকলকে আমলের সুযোগ দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং উভয় দফতরের কথা ঘোষণা করেছেন। এখন দুনিয়াতে যারা দফতরের উপর ঈমান তো রাখবে কিন্তু দফতরের ভরসায় আমল পরিত্যাগ করবে না, হাশরের ময়দানে দেখা যাবে- শুধু তাদেরই নাম জান্নাতী দফতরে লেখা আছে। আর যারা দফতরের উপর নির্ভর করে আমল করেনি, দুনিয়ার ব্যাপারে তাঁরা খুব বুদ্ধিমান হলেও আখেরাতের ব্যাপারে বড়ই অলস। অথচ যুক্তি-তর্কে খুব পারদর্শী। হাশরের ময়দানে দেখা যাবে যে এ লোকগুলোর নাম জাহান্নামের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সারকথা, আল্লাহর এ কিতাবদ্বয়ের উপর নির্ভর করে আমল ছেড়ে দেয়া যাবে না বরং আমল করতে হবে তাহলে পরকালে জান্নাতী হওয়া যাবে।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৩ ফেব, ২১