টাকা দিয়ে সদকাতুল ফিতির আদায় করা যাবে কি

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসযাকাত-ফিতরা১৩ মে, ২১

প্রশ্ন

টাকা দিয়ে সদকাতুল ফিতির আদায় করা যাবে কি?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

টাকা দ্বারা ‘‘ফিতরা’’ দেয়া হাদীস ও ইমামগণের উক্তি দ্বারা প্রমাণিত বর্তমানে আমাদের দেশে গায়রে মুকাল্লেদগণ ফাতওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে যে, ‘‘সহীহ বুখারীর মাঝে আছে ফিতরা দিতে হবে গম, খেজুর, কিসমিস, পনীর ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য দিয়ে। টাকা দিয়ে আদায় করলে আদায় হবে না!’’ তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

তাছাড়াও ইমাম বুখারী i , ইবনে আবী শায়বা i ও বায়হাকি i বলেন, টাকা দিয়ে ফিতরা দিলে আদায় হয়ে যাবে। যদি গম, কিসমিস, পনীর ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করে, তাহলে হয়ে যাবে। তার দলীল বুখারী থেকে-

حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ السَّكَنِ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَهْضَمٍ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ عُمَرَ بْنِ نَافِعٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَال: «فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى العَبْدِ وَالحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ مِنَ المُسْلِمِينَ، وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ» «تعليق مصطفى البغا» «فرض» أوجب أو قدر • হযরত ইবনে উমর e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর রাসূলুল্লাহ c সাদকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ সাদাকাতু্ল ফিত্‌র আদায় করা আবশ্যক করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। -বুখারী-২/১৩১, হাদীস-১৫০৬

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، عَنْ عِيَاضِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي سَرْحٍ العَامِرِيِّ، أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا سَعِيدٍ الخُدْرِيَّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، يَقُول: «كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيبٍ» • হযরত আবূ সাঈদ খুদরী e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা’ পরিমাণ যব অথবা এক সা’ পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা’ পরিমাণ পনির অথবা এক সা’ পরিমাণ কিসমিস দিয়ে زَكَاةَ الفِطْرِ সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। -বুখারী-২/১৩১, হাদীস-১৫০৬

উল্লেখ্য যে, উক্ত দুটি হাদীস দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, কোন ব্যক্তি চাইলে মাল দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবে। কিন্তু টাকা দ্বারা আদায় করা ভুল এধরনের কোন আলোচনা নেই।

আর زَكَاةَ الفِطْرِ সাদাকায়ে ফিতর হলো ওয়াজিব। এখন প্রশ্ন জাগে তাহলে ইমাম বুখারী অনুচ্ছেদের মাঝে ফরয শব্দ ব্যবহার করেছেন আর হাদীসের মাঝেও ফরয শব্দ এসেছে, তাহলে ওয়াজিব কোথা থেকে আসলো? তার উত্তরে বলা হবে, ইমাম বুখারী i এর নিকট ওয়াজিব আর ফরয দুটি এক। তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ইমাম বুখারী তার সহীহ বুখারীর মাঝে এক অনুচ্ছেদ এভাবে বলেন- باب وجوب الحج অর্থাৎ এ অনুচ্ছেদ হজ্ব ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে! অথচ আমরা সকলেই জানি হজ্ব ফরয। তাহলে ইমাম বুখারী ওয়াজিব বললেন কেন? তার জবাব হলো ইমাম বুখারীর নিকট ফরয ও ওয়াজিব এক।

আর হাদীসের মাঝে ফরয শব্দ ব্যবহার হলেই সর্ব স্থালে তার দ্বারা ফরয উর্দ্দেশ্য নয়। কেননা হাদীসের পরিভাষা দেখলে দেখা যায় ফরয শব্দটি কখনো أوجب قدر عين بين অর্থাৎ ওয়াজিব, নির্ধারণ, বর্ণনা, ব্যাখ্যা ইত্যাদি অর্থেও প্রয়োগ হয়। অতএব ফরযের দাবী করে উত্তাল হয়ে যাওয়ার সুযোগ কোথায়? -সহীহ বুখারী, ৫/৬৩, হাদীস-৩৯১২; সহীহ বুখারী,৬/১৫৬

‘‘ফিতরা’’ টাকা দ্বারা আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। তার দলীল-

حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ زُهَيْرٍ، قَال: سَمِعْتُ أَبَا إِسْحَاقَ، يَقُول: «أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ» • হযরত যুহাইর i থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক i থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম e কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে টাকা দ্বারা আদায় করতেন। -ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭১ এটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ তথা প্রমাণযোগ্য।

তেমনি ভাবে ইবনে আবী শায়বার মাঝে টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার ব্যাপারে রয়েছে হযরত হাসান বসরী i এর আসার- حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ هِشَامٍ، عَنِ الْحَسَنِ، قَال: «لَا بَأْسَ أَنْ تُعْطِيَ الدَّرَاهِمَ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ» • অর্থ, হযরত হাসান বসরী i বলেন, টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার দ্বারা কোন সমস্যা নেই। -ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭০

অনুরুপ ভাবে রয়েছে এ বিষয়ে হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয i এর চিঠি- حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ قُرَّةَ، قَال: جَاءَنَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ «نِصْفُ صَاعٍ عَنْ كُلِّ إِنْسَانٍ أَوْ قِيمَتُهُ نِصْفُ دِرْهَمٍ» -ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৬৯

এছাড়াও বিখ্যাত ইমাম, ইমাম ইবনে আবী শায়বা তার রচিত কিতাব ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮ এর মাঝে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে- فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ অর্থাৎ সাদাকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার (বৈধতা) সম্পর্কে। আর ইমাম বায়হাকী i তার রচিত কিতাব সুনানুল কুবরা-৪/১৮৯ এর মাঝে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে–بَابُ مَنْ أَجَازَ أَخْذَ الْقِيَمِ فِي الزَّكَوَاتِ • অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ হলো টাকা দ্বারা যাকাত আদায় করা অনুমোদিত।

তাছাড়াও রাসূল c এর যুগেও زَكَاةَ الفِطْرِ زكوة ইত্যাদি টাকা দ্বারা আদায় করা হতো। তার কিছু প্রমাণ নিম্মে পেশ করা হলো-

وَقَالَ طَاوُس: قَالَ مُعَاذٌ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ لِأَهْلِ اليَمَن: «ائْتُونِي بِعَرْضٍ ثِيَابٍ خَمِيصٍ – أَوْ لَبِيسٍ – فِي الصَّدَقَةِ مَكَانَ الشَّعِيرِ وَالذُّرَةِ أَهْوَنُ عَلَيْكُمْ وَخَيْرٌ لِأَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمَدِينَةِ» وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم: وَأَمَّا خَالِدٌ فَقَدِ احْتَبَسَ أَدْرَاعَهُ وَأَعْتُدَهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ”وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم: «تَصَدَّقْنَ وَلَوْ مِنْ حُلِيِّكُنَّ» فَلَمْ يَسْتَثْنِ صَدَقَةَ الفَرْضِ مِنْ غَيْرِهَا، فَجَعَلَتِ المَرْأَةُ تُلْقِي خُرْصَهَا وَسِخَابَهَا، وَلَمْ يَخُصَّ الذَّهَبَ وَالفِضَّةَ مِنَ العُرُوضِ“ -সহীহ বুখারী-২/১১৬

উল্লেখ্য যে, সাদাকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করা যাবে এটি ইমাম বুখারী i এরও উক্তি- (قَوْلُهُ بَابُ الْعَرْضِ فِي الزَّكَاةِ) أَيْ جَوَازُ أَخْذِ الْعَرْضِ وَهُوَ بِفَتْحِ الْمُهْمَلَةِ وَسُكُونِ الرَّاءِ بَعْدَهَا مُعْجَمَةٌ وَالْمُرَادُ بِهِ مَا عَدَا النَّقْدَيْنِ قَالَ بن رَشِيدٍ وَافَقَ الْبُخَارِيُّ فِي هَذِهِ الْمَسْأَلَةِ الْحَنَفِيَّةَ مَعَ كَثْرَةِ مُخَالَفَتِهِ لَهُمْ لَكِنْ قَادَهُ إِلَى ذَلِكَ الدَّلِيلُ …الخ

আল্লামা ইবনু রাশীদ i বলেন, উক্ত মাসয়ালাটির মাঝে ইমাম বুখারী i হানাফীদের সহমত পোষন করেছেন…। -ফাতহুল বারী লি ইবনে হাজার-৩/৩১২

এ বিষয়ে আহমদ আল গুমারী i এর আরবী ভাষায় ১৫০ পৃষ্ঠায় ‘‘تحقيق الامال فى فى اخراج زكوة الفطر بالمال ’’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা রচনা করেছেন। যা সকলকে পড়ে রাখা আবশ্যক।

এ বিষয়ে আরো দেখুন- বাদায়েউস সানায়ে-২/৯৬৯, আল মাবসুত লিসসারাখসী-৩/১১৩ ইত্যাদি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ফেৎনা সৃষ্টি না করে সঠিক দ্বীন বুঝে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৩ মে, ২১