জিহাদ করা দ্বীন শিখা তাবলীগ করা তাসাওফের মেহনত করা সবই দ্বীনের কাজ!

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসবিবিধ১৩ জানু, ২২

প্রশ্ন

আমার প্রশ্নের বিষয় হল তাবলীগ নিয়ে।

আমি দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের সাথে কিছু সময় দিয়েছি। আমার এক বন্ধু আহলে হাদিস হয়ে গেছে যদিও সে পূর্বে হানাফি মাযহাবের অনুসারি ছিল এবং তাবলীগে কিছু সময় দিয়েছিল। কিন্তু এখন সে তাবলীগের বিরোধিতা করে। সে আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছেঃ

১. তাবলীগী ভাইরা জিহাদ করে না কেন? জুলুম, অন্যায় দেখে ও তারা এর বিরুদ্ধে জিহাদ করে না কেন?

২. তাবলীগী ভাইরা ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করে না কেন? নবীজি c তো খিলাফর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাবলীগের দ্বারা কিভাবে দেশের সর্বস্তরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে? হজরত যদি দলিলসহ বিস্তারিত আলোচনা করেন তাহলে উপকৃত হব।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

দ্বীন কাজের অনেকগুলো শাখা আছে। এর মাঝে তাবলীগ একটি প্রধানতম শাখা। আরো যেসব শাখা রয়েছে, উদাহরণতঃ

১. গ্রহণযোগ্য আমীরের নেতৃত্বে কাফিরদের মুকাবিলা করে দ্বীনে ইসলামকে সমুন্নত করার মানসে জিহাদ করা।

২. খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মানসে কাজ করা।

৩. ইসলাম বিদ্বেষীদের ইসলামের বিরুদ্ধে নানাভিদ অপপ্রচার ও মিথ্যা অভিযোগের জবাব দেয়া।

৪. ইসলামের মৌল বিশ্বাস ও আমল সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক সঠিক সমাধান জানিয়ে জাতিকে শিরক-বিদআত থেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা-মেহনত চালিয়ে যাওয়া।

৫. কুরআন ও সুন্নাহের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে হকের আওয়াজকে বুলন্দ করা। সঠিক পদ্ধতিতে যারাই উপরোক্ত কাজ করছেন, তারা সবাই দ্বীনের কাজ করছেন। কারো কাজ কারো কাজ থেকে কম নয়। সম্পূর্ণ কুফরীর অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে দ্বীনের আলোয় আলোকিত করতে রাসূল c ঘামঝড়া মেহনত করেছেন। শুধু ঘামঝরা নয়, রক্তঝরা মেহনত করেছেন। সাহাবাগণ অকাতরে জীবন বিলিয়েছেন। ঘর-বাড়ি সংসার সব ছেড়ে দ্বীনের দাওয়াতের জন্য, দ্বীনকে বুলন্দ করতে জিহাদের ময়দান থেকে জিহাদের ময়দানে ছুটে বেরিয়েছেন।

সেই সাথে একদল সাহাবা সারাক্ষণ মসজিদে নববীতে দিনরাত পরে থেকে দ্বীনের ইলম আহরণ করেছেন, দ্বীনী বিষয়ে প্রাজ্ঞতা অর্জনের জন্য। কারণ মূল দ্বীন হল, আল্লাহর আদেশ আর নিষেধ পালন করার নাম। যদি কুরআন ও হাদীস আত্মস্থকারী গবেষক ব্যক্তিগণ না থাকেন, তাহলে পুরো জাতি ধর্মের নামে অধর্ম পালন করতে শুরু করে দিবে। তারা বুঝতেই পারবে না, তারা যা পালন করছে বা যা বলছে তা দ্বীন নয়। তাই ইলমে দ্বীন অন্বেষণ করা, দ্বীন শিক্ষার কাজে ব্রত থাকা দ্বীনের একটি অত্যাবশ্যকীয় ফরজ কাজ। সেই সাথে প্রয়োজনে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়াও দ্বীনের একটি ফরজ কাজ। ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার মেহনতও দ্বীনের কাজ। এক কথায় একটি আরেকটির পরিপূরক। কোনটির অবদানই কোনটি থেকে কম নয়। তবে সকল জমানায়ই সবচে’ বড় কাজ অবশ্যই কুরআন ও হাদীসের প্রাজ্ঞ আলেম তৈরী করা। কারণ প্রাজ্ঞ আলেম না থাকলে, কুরআনের অপব্যাখ্যা, মিথ্যা-জাল বর্ণনা মানুষের ঈমানে বিশ্বাসে ঢুকে পড়ে অবশেষে গোটা ধর্মটাই একটি বিকৃত ধর্মে রূপ লাভ করবে। এ কারণে প্রাজ্ঞ আলেম তৈরী করার প্রচেষ্টা দ্বীনের একটি আবশ্যকীয় জরুরী বিষয়।

সেই সাথে দ্বীনের তাবলীগও দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়। রাসূল c সারা জীবন মৌলিকভাবে যে কাজ করে গেছেন সেটির নাম তাবলীগ।

সেই সাথে রাসূল c সশরীরে ২৭টি জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। সুতরাং জিহাদও একটি ফরজ আমল। আমলী জিন্দেগী গঠন করতে অসংখ্য হাদীস বলে গেছেন। যা বুঝে পালন করা উম্মতের জন্য জরুরী। তাই ইলমে দ্বীন অন্বেষণ করাও ফরজ। সঠিক পদ্ধতিতে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও দ্বীনের একটি অংশ। সবাই একসাথে সব কাজ করতে সক্ষম নয়। তাই সবাইকে সব কাজের জন্য বাধ্য করাও উচিত নয়। একদল দ্বীনের যে কাজ করছেন, তারা অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব রাখাও উচিত নয়। কিংবা ছোট নজরে দেখারও কোন অবকাশ নেই।

স্পষ্টভাষায় বুঝে নিন-

তাবলীগই দ্বীনের কাজ মনে করা গোমরাহী, বলতে হবে তাবলীগও দ্বীনের কাজ।

জিহাদই দ্বীনের কাজ মনে করা গোমরাহী, বলতে হবে জিহাদও দ্বীনের কাজ।

খিলাফত প্রতিষ্ঠার মেহনতই দ্বীনের কাজ মনে করা গোমরাহী, বলতে হবে খিলাফত প্রতিষ্ঠার মেহনতও দ্বীনের কাজ।

ইলমে দ্বীন শিখায় রত থাকাই দ্বীনের কাজ মনে করা গোমরাহী, বলতে হবে ইলমে দ্বীন শিখায় রত থাকাও দ্বীনের কাজ।

আত্মশুদ্ধি হাসিলের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে মেহনত করাই দ্বীনের কাজ মনে করা গোমরাহী, বলতে হবে আত্মশুদ্ধি হাসিলের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে মেহনত করাও দ্বীনের কাজ। এইভাবে যারাই সঠিক পদ্ধতিতে দ্বীনের কাজ করছেন, সবাইকে এক কাজে নিয়ে আসার জন্য বলা বোকামী বৈ কিছু নয়। সবাইকে নিজের মত সঠিক পদ্ধতিতে দ্বীনের কাজ করতে দিন। তবে সবার পদ্ধতিই যেন কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক পদ্ধতি হয় এটি হল বিবেচ্য বিষয়।

সুতরাং তাবলীগ জামাতের ভাইরা কেনসশস্ত্র জিহাদে অংশ নেয় না, ইসলামী খিলাফতের জন্য আন্দোলনে রত হয় না? এ প্রশ্নটি করা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি সকল হক্কানী মুজাহিদগণ কেন কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ রেখে দাওয়াত ও তাবলীগে এসে যায় না এমন প্রশ্নও অযৌক্তিক। এমনিভাবে সকল প্রাজ্ঞ গবেষক আলেমকে দাওয়াত ও তাবলীগের চিল্লায় পাঠানোর মানসিকতাও একটি অযৌক্তিক মানসিকতা। যেমন সকল দাওয়াত তাবলীগের সাথিদের মাদরাসায় ভর্তি করে বিজ্ঞ আলেম বানানোর জন্য চেষ্টা করা অযৌক্তিক।

যাইহোক। সহজ কথা হল, সঠিক পদ্ধতিতে যারাই দ্বীনের কাজ করছেন, সবাই হকের পথে আছেন। সকলের কাজই প্রশংসনীয়। সবার জন্য সব কাজ করা সম্ভব নয়। তবে সবাইকে সবাই সাপোর্ট দিতে হবে। তাহলেই ইসলামের বিজয় সহজ হবে। শক্তি বৃদ্ধি পাবে। অযথা বিতর্ক আমাদের মাঝে বিভক্তির দেয়ালকেই মজবুত করে দিবে। যা ইহুদী খৃষ্টানদের সর্বদার চাওয়া।

বিঃদ্রঃ দাওয়াত ও তাবলীগের বর্তমান পদ্ধতিতে যদিও দ্বীন প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে জনবল দরকার, ইনশাআল্লাহ তাবলীগের মাধ্যমে সে জনবল বৃদ্ধি হচ্ছে। তাই দাওয়াত ও তাবলীগ নিয়ে অযথা বিতর্ক উঠানো কিছুতেই ঠিক হবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের হককে হক বুঝার, বাতিলকে বাতিল বুঝার তৌফিক দান করুন। দলীল وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ • আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। -সূরা আলে ইমরান: ১০৪ كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُم مِّنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ • তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায়কার্যে আদেশ এবং অন্যায় কার্যে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস কর। -সূরা আলে ইমরান: ১১০

এরকম অসংখ্য আয়াতে তাবলীগের সাথে সাথে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে বলার জন্যও আদেশ এসেছে। যা স্পষ্টভাষায় তাবলীগের সাথে অন্যায় কাজের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেষ্টা-মেহনতের প্রবাণবাহী।

জিহাদের ক্ষেত্রে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে, নিচে শুধু একটি হাদীস উল্লেখ করছি-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ، وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ، مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ» • হযরত আবূ হুরায়রা e থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মারা গেল, কিন্তু ইসলামী যুদ্ধ তথা জিহাদে যায়নি, কিংবা জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছেও অন্তরে পোষণ করেনি, সে এক প্রকার মুনাফিকীর (অবস্থায়) মৃত্যুবরণ করল। -সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৯১০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৮০২

عن عبد الله بن عمرو بن العاص قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول (إن الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد ولكن يقبض العلم بقبض العلماء حتى إذا لم يبق عالما اتخذ الناس رؤوسا جهالا فسئلوا فأفتوا بغير علم فضلوا وأضلوا • হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস e থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে ইলম টেনে বের করে উঠিয়ে নেবেন না; বরং আলেমগণকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমেই ইলম তুলে নিবেন। শেষ পর্যন্ত দুনিয়ায় যখন আর কোন আলেমকেই বাকি রাখবেন না, তখন মানুষ গন্ড মুর্খদেরকে নেতারূপে গ্রহণ করবে। তারপর তাদের নিকটই মাসআলা মাসায়েল জিজ্ঞেস করা হবে, আর তারা শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়াই ফাতওয়া দিবে। এভাবে নিজেরাও ভ্রান্ত হবে এবং অপরকেও বিভ্রান্ত করবে। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং-৪৫৭১, বুখারী শরীফ, হাদিস নং-১০০, সহীহ মুসলিম শরীফ, হাদিস নং-৬৯৭১, মুসনাদুশ শিহাব, হাদিস নং-৫৮১, আল মু’জামুল আওসাত, হাদীস নং-৫৫, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং-৫২,সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৫২, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২৩৯, সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-৫৯০৭, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৫৬১১, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-২৪২২, মুসনাদে ইবনুল জিদ, হাদীস নং-২৬৭৭, মুজামে ইবনে আসাকীর, হাদীস নং-১৭২

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৩ জানু, ২২