চেয়ারে বসে নামায পড়া বিষয়ক কয়েকটি জরুরী মাসআলা

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসনামায১ জুন, ২২

প্রশ্ন

আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে তাকালে বর্তমানে দেখতে পাই যে, চেয়ারে নামায পড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। একজন ব্যক্তি সারাদিন ঘুরাঘুরি করছে। বাজারে যাচ্ছে। বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে কিন্তু মসজিদে এসে চেয়ারে বসে নামায পড়ছে। এ ব্যাপারে আপনাদের কাছে কয়েকটি বিষয় জানতে চাই। ১ সেজদা করতে না পারলেই কি চেয়ারে বসে নামায পড়া যায়? ২ বসে নামায না পড়তে পারলে সামনে টেবিল রেখে তাতে সেজদা দেয়ার হুকুম কি? দয়া করে বিস্তারিত জানালে উপকৃত হবো।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

চেয়ারে বসে কখন নামায পড়তে পারবে? আজকাল আমাদের দেশে চেয়ারে বসে নামায পড়া ফ্যাশন হয়ে গেছে। যা কিছুতেই কাম্য নয়। এখানে কয়েকটি বিষয় ভাল করে লক্ষ্য রাখতে হবে। ১ নং মাসআলা যে ব্যক্তি রুকু সেজদা করতে সক্ষম উক্ত ব্যক্তি যদি চেয়ারে বসে নামায পড়ে তাহলে উক্ত ব্যক্তির নামায হবে না। কারণ রুকু সেজদা নামাযের রুকন। তা কারণ ছাড়া ছেড়ে দিলে নামায হবে না। من فرائضها القيام فى فرض لقادر عليه وعلى السجود، الدر المختار مع رد المحتار-2/132) এমনকি যদি কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। উক্ত ব্যক্তি যদি যতটুকু সময় দাঁড়াতে পারে ততটুকু সময় দাঁড়ানোর চেষ্টা না করেই বসে নামায পড়ে, তাহলেও উক্ত ব্যক্তির নামায হবে না। যতক্ষণ সময় দাঁড়াতে পারে ততক্ষণ দাঁড়াবে। তারপর যখন দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে যাবে, তখন বসে যাবে। এমনকি যদি লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে বা হেলান দিয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে যদি নিকটে লাঠি থাকে বা হেলান দেবার সুযোগ থাকে, তাহলে লাঠিতে ভর দিয়ে বা হেলান দিয়ে হলেও দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে। বসবে না। যদি লাঠি বা হেলান দেয়ার সুযোগ থাকা সত্বেও অযথাই বসে নামায পড়ে তাহলেও উক্ত ব্যক্তির নামায হবে না। তবে যদি একদম দাঁড়াতেই না পারে, বা দাঁড়ালে মাথা ঘুরে পড়ে যায়, তাহলে বসে নামায পড়ার সুযোগ রয়েছে। وان قدر على بعض القيام ولو متكئا على عصا أو حائط قام لزوما وما قدر ما يقدر ولو قدر آية أو تكبيرة على المذهب لأن البعض معتبر بالكل، (الدر المختار مع رد المحتار-2/267) ২ নং মাসআলা যে ব্যক্তি বসে রুকু ও সেজদা করতে সক্ষম উক্ত ব্যক্তির জন্য চেয়ারে বসে নামায জায়েজ নয়। সেজদা করতে সক্ষম হওয়া সত্বেও চেয়ারে বসে নামায পড়লে নামায হবে না। কারণ সেজদা নামাযের একটি স্বতন্ত্র রুকন। যা কোন কারণ ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আর নামাযের কোন রুকন কারণ ছাড়া ছেড়ে দিলে নামায হয় না। وإن عجز عن القيام وقدر على القعود، فإنه يصلى المكتوبة قاعدا بركوع وسجود ولا يجزيه غير ذلك، (تاتارخانية-2/667) ৩ নং মাসআলা যে ব্যক্তি জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম) যদি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে সক্ষম হয় তাহলে তাকে দাঁড়িয়েই নামায আদায় করতে হবে। আর যেহেতু সে সিজদা করতে অক্ষম তাই সে ইশারায় সিজদা করবে (যদি রুকু করতেও অক্ষম হয় তাহলে রুকুও ইশারায় আদায় করবে)। জমিনে সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে দাঁড়ানোর ফরয ছাড়া যাবে না। -‘ফাতহুল কাদীর’ খ. ১ পৃ. ৪৬০,‘আননাহরুলফায়েক খ. ১ পৃ. ৩৩৭ এবং ‘ইলাউস সুনান খ. ৭ পৃ. ২০৩ কিয়ামের ফরয আদায় থেকে শুধু ঐ ব্যক্তি ছাড় পাবে যে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম। সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে কিয়াম-এর ছাড় পাবে না। কিয়াম নামাযের একটি স্বতন্ত্র ফরয তা শুধু সিজদার জন্য নয়। যে ব্যক্তি দাড়িয়ে নামায শুরু করতে পারে কিন্তু সিজদার জন্য জমিনে বসার পর আবার দাঁড়াতে তার অনেক কষ্ট হয়, এমন ব্যক্তিও কিয়াম (দাঁড়িয়ে নামায পড়া) একেবারে ছাড়বে না। বরং প্রথম রাকাত দাড়িয়ে আদায় করবে। এরপর দাঁড়াতে কষ্ট হওয়ার কারণে বাকী নামায বসে আদায় করবে। যে ব্যক্তি শুধু আরামের জন্য অথবা মামুলি কষ্টের বাহানায় চেয়ারে নামায আদায় করছেন তিনি মস্ত বড় ভুলকাজ করছেন। এভাবে নামায আদায় করার দ্বারা তার নামাযই হবে না। তার উপর ফরয, দাড়িয়ে নামায আদায় করা এবং যথা নিয়মে রুকু সিজদা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি জমিনের উপর বসে নামায আদায় করতে সক্ষম তার জন্য শুধু এই বাহানায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করা ঠিক নয় যে, সে দাড়িয়ে নামায আদায় করতে বা রুকু সিজদা করতে অক্ষম। বরং এ ধরণের লোকেরা জমিনে বসে নামায আদায় করবে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করবেন শুধু ঐ লোকেরা যারা জমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারকাতুহুম তার সদ্য লেখা এ ফতওয়ায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করার ক্ষতির দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,‘জমিনে বসে নামায আদায় করার শক্তি থাকাসত্ত্বেও চেয়ারে বসার যে প্রচলন দেখা যায় তাতে বিভিন্ন দিক থেকে আপত্তি রয়েছে। ১. মাযুর ব্যক্তিদের জন্য জমিনে বসে নামায আদায় করাই উত্তম ও মাসনূন তরীকা। এর উপরই সাহাবায়েকেরাম h এবং পরবর্তীদের আমল চলে আসছে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করার রেওয়াজ কেবল শুরু হয়েছে। খায়রুল কুরূনে এর নযীর নেই। অথচ সে যুগে মাযুরও ছিল চেয়ারও ছিল। ২. যে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মাযুর নয়, অর্থাৎ কিয়াম, রুকু সিজদা করতে সক্ষম, তার জন্য জমিনে বাচেয়ারে বসে ফরয এবং ওয়াজিব নামায আদায় করাই জায়েয নেই। অথচ কখনো কখনো দেখা যায় এধরণের সুস্থ ব্যক্তিও সামনে চেয়ার পেয়ে চেয়ারে বসে নামায আদায় করে নেয়। ফলে তার নামাযই হয় না। ৩. চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কাতার সোজা করা ও সোজা রাখার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অথচমিলে মিলে দাড়ানো ও কাতার সোজা করার বিষয়ে হাদীস শরীফে জোর তাকীদ এসেছে। ৪. বিনা প্রয়োজনে মসজিদে চেয়ারের অধিক্যের কারণে তা নাসারাদের গির্জা ও ইহুদীদের উপাসনালয়ের সাদৃশ দেখা যায়। তারা গির্জায় চেয়ার ও বেঞ্চে বসে উপাসনা করে। আর দ্বীনী বিষয়ে ইহুদী নাসারা ও অন্যান্য জাতির সাদৃশ্য থেকেহ নিষেধ করা হয়েছে। ৫. নামায তো এমন ইবাদত যা আদায় করতে হয় বিনয়াবনত হয়ে বিগলিত চিত্তে। আর চেয়ারে বসে নামাযআদায় করার চেয়ে জমিনে বসে নামায আদায়ের মাঝে তা পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়। ৬. কোন কোন যুবক ও সুস্থ ব্যক্তি নামাযের পর মসজিদে রাখা চেয়ারে বসে আরাম করে। কখন কখনো চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়। এটা মসজিদের পবিত্রতা, মার্যাদা ও আদবের খেলাফ। ৭. মসজিদে চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কোন কোন ছুরতে কুরআনে কারীম এবং মুরববী নামাযীদের আদবও এহতেরামের ব্যত্যয় ঘটে।’’ (নমুনা স্বরূপ আপত্তির এ সাতটি দিক উল্লেখ করার পর হযরত লেখেন : اس لئے اشارہ سے نماز پرهنے كے لئے بهى حتى الامكان كرسيوں كے استعمال سے بچنا چاہئے اور ان كے استعمال كى حوصلہ شكنى كرنى چاہئے، اور ان كا استعمال صرف ان حضرات كى حد تك محدود كرنا چاہئے جو زمين پر بيٹهكر نماز ادا كرنے پر قادر نہ ہوں. ‘‘…এ জন্যই ইশারায় নামায আদায় করার জন্যও যথাসম্ভব চেয়ারের ব্যবহার না করা চাই। চেয়ারব্যবহারের প্রতি নিরুৎসাহিত করা চায় এবং এর ব্যবহার কেবলমাত্র ঐ সকল ব্যক্তির মাঝে সিমাবদ্ধ করা উচিত, যারা জমিনে বসে নামায আদায় করতে সক্ষম নয়।’’ এই স্পষ্ট বক্তব্য সত্ত্বেও হযরত আবার এটাও লিখেছেন যে, রুকু সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনেরউপর বসে ইশারায় নামায আদায় করতে সক্ষম হওয়ার পরও যদি চেয়ারে বসে নামায আদায় করে থাকেন,তাহলে সেটাও জায়েয, কিন্তু অনুত্তম কাজ। আর দারুল উলূম দেওবন্দের ফতওয়ায় এটাকে শুধু অনুত্তমই বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, তা বিভিন্ন কারণে ‘কারাহাত’ মুক্ত নয়। (ফাতাওয়া দারুল উলুম করাচি, ফাতাওয়া নং- ৪১/১৫০৮,২ রবিউস সানী ১৪৩৪হিজরী) তাই রুকু সেজদা করতে সক্ষম না হলেও চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে। বাকি এমতাবস্থায় রুকু সেজদা চেয়ারে বসে দেয়া জায়েজ আছে। তবে অনুত্তম। কিন্তু কিয়াম বাদ দিবে না যদি দাঁড়াতে সক্ষম হয়। আর যদি দাঁড়াতেও সক্ষম না হয়, তাহলে বসে ইশারায় নামায পড়বে। এ অবস্থায়ও চেয়ার ব্যাবহার অনুচিত। হ্যাঁ, যদি চেয়ার ছাড়া নিচে বসতেই পারে না। তাহলে দুই পা ছড়িয়ে বসে নামায পড়বে। যদি এতেও সক্ষম না হন, তাহলে চেয়ারে বসে নামায আদায় করবেন। عن عمران بن حصین – رضي الله عنه – قال : کانت بي بواسیرُ، فسألتُ النبي – صلی الله علیه وسلم – عن الصلاة، فقال : ” صلّ قائمًا ، فإن لم تستطع فقاعدًا ، فإن لم تستطع فعلی جنبٍ“۔ হযরত ইমরান বিন হুসাইন e থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেন, তোমরা দাড়িয়েঁ নামায পড়। যদি তোমরা দাঁড়াতে সক্ষম না হও, তাহলে বসে নামায পড়। আর যদি বসতেও সক্ষম না হও তাহলে কাত হয়ে নামায পড়। -বুখারী, হাদীস নং-১১১৭,১০৬৬ ৪ নং মাসআলা ইশারায় নামায পড়ার সময় বা চেয়ারে বসে নামায পড়ার সময় সামনে টেবিল রেখে তাতে সেজদা দেবার কোন প্রয়োজন নেই। টেবিলে সেজদা দেয়া আর শুধু ইশারা করার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কারণ এর দ্বারা মূল সেজদা আদায় হয় না। কারণ- ১. সিজদার জন্য শর্ত হল, উভয় হাঁটু জমিনের উপর রাখা। ২. সিজদার সময় কপালের অংশ কোমরের অংশথেকে নীচু থাকা দরকার। চেয়ারে বসে সামনের কোন কিছুর উপর কপাল রাখলে উল্লিখিত উভয় শর্ত পাওয়াযায় না। সুতরাং সেটাকে হাকীকী সিজদা (নিয়মতান্ত্রিক সিজদা) বলা ঠিক নয়। إن كان الموضوع مما يصح السجود عليه كحجر مثلا ولم يزد ارتفاعه على قدر لبنة أو لبنتين فهو سجود حقيقى، فيكون راكعا ساجدا، وإن لم يكن الموضوع كذالك يكون مومئا، فلا يصح اقتداء القائم به، (رد المحتار-2/569)

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১ জুন, ২২