চরমোনাই মাহফিলে মুরীদরা লাফালাফি করে কেন

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসসভ্যতা ও সংস্কৃতি১১ এপ্রিল, ২১

প্রশ্ন

আমরা জানি যে, চরমোনাই পীর হল হকপন্থী পীর। কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ দেখাচ্ছে যে তারা ভন্ড। প্রমান হিসাবে তারা দেখায় তাদের জলসা চলাকালীন সব অদ্ভুত লাফালাফি আর চিল্লাচিল্লির দৃশ্য। আমার প্রশ্ন এসব লাফালাফি আর চিল্লাচিল্লির কারন কি? তাবলীগী অথবা অন্য কোন বুযুর্গের বয়ানেতো এভাবে লাফালাফি বা চিল্লাচিল্লি করা হয়না। এর আসল রহস্য কি?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মোহাব্বতে অনিচ্ছায় যদি কারো মাঝে পাগলামী চলে আসে, তাহলে লোকটিকে অপারগ ধরা হবে। এ কারণে লোকটি গোনাহগার হবে না। জাহান্নামের কথা শুনে, কবরের আজাবের কথা শুনে, নিজের পূর্ব জীবনের গোনাহের কথা স্মরণ হওয়ায় চোখে পানি আসা, মনে হাহাকার আসা ঈমানদারের লক্ষণ। পক্ষান্তরে মন শক্ত থাকা, মনে সামান্য পরিমাণও ব্যথিত না হওয়া খুবই নিন্দনীয় হালাত। বেশি বেশি জিকির ও কবর-হাশর, জান্নাত জাহান্নামের কথা স্মরণ করে মনকে নরম করা উচিত। إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ • যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ার দেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। -সূরা আনফাল, ২ وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ۞ وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُنْ مِنَ الْغَافِلِينَ • আর স্মরণ করতে থাক স্বীয় পালনকর্তাকে আপন মনে ক্রন্দনরত ও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় এবং এমন স্বরে যা চিৎকার করে বলা অপেক্ষা কম; সকালে ও সন্ধ্যায়। আর বে-খবর থেকো না। নিশ্চয়ই যারা তোমার পরওয়ারদেগারের সান্নিধ্যে রয়েছেন, তারা তাঁর বন্দেগীর ব্যাপারে অহঙ্কার করেন না এবং স্মরণ করেন তাঁর পবিত্র সত্তাকে; আর তাঁকেই সেজদা করেন। -সূরা আরাফ, ২০৫-২০৬ اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ আল্লাহ উত্তম বাণী তথা কিতাব নাযিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, পূনঃ পূনঃ পঠিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই। -সূরা যুমার, ২৩ وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ • আর তারা রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন; এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলেঃ হে আমাদের প্রতি পালক, আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। অতএব, আমাদেরকেও মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন। -সূরা মায়িদা, ৮৩

উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াতে উল্লেখিত হালাত ছিল সাহাবায়ে কেরাম এবং বুযুর্গানে দ্বীনের। জোরে চিল্লা-ফাল্লা করতেন না। অঝর ধারায় তাদের চোখ থেকে অশ্রু বইয়ে যেত। আফসোস আর হাহাকারে মনটা আনচান করে উঠতো। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চিৎকার করে নয়, স্বাভাবিক স্বরে ক্রন্দন করতেন। তবে যদি কোন দুর্বল চিত্তের মানুষ, নিজের অনিচ্ছায় জোরে চিৎকার করে উঠে, পাগলামী শুরু করে দেয়, হাহাকার করে উঠে সজোরে। তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে অপারগ ধরা হবে। অনিচ্ছায় এমন হওয়ার কারণে সে গোনাহগার হবে না। কিন্তু যদি ইচ্ছেকৃত এমনটি করে। ইচ্ছেকৃত জিকিরের মজলিসে লাফিয়ে উঠে, নাচতে শুরু করে দেয়, হৈ হুল্লোড় করতে থাকে, পাগলামী করতে থাকে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি ফাসিক। মারাত্মক গোনাহগার। এমন করা শিরকের নামান্তর। হারাম। একদমই হারাম কাজ এটি। ইচ্ছেকৃত চিৎকার ও লাফালাফির ব্যাপারে ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী i বলেনঃ

وَأَمَّا مَا ابْتَدَعَهُ الصُّوفِيَّةُ فِي ذَلِكَ فَمِنْ قَبِيلِ مَا لَا يُخْتَلَفُ فِي تَحْرِيمِهِ لَكِنَّ النُّفُوسَ الشَّهْوَانِيَّةَ غَلَبَتْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ يُنْسَبُ إِلَى الْخَيْرِ حَتَّى لَقَدْ ظَهَرَتْ مِنْ كَثِيرٍ مِنْهُمْ فِعْلَاتُ الْمَجَانِينِ وَالصِّبْيَانِ حَتَّى رَقَصُوا بِحَرَكَاتٍ مُتَطَابِقَةٍ وَتَقْطِيعَاتٍ مُتَلَاحِقَةٍ وَانْتَهَى التَّوَاقُحُ بِقَوْمٍ مِنْهُمْ إِلَى أَنْ جَعَلُوهَا مِنْ بَابِ الْقُرَبِ وَصَالِحِ الْأَعْمَالِ وَأَنَّ ذَلِكَ يُثْمِرُ سِنِيِّ الْأَحْوَالِ وَهَذَا عَلَى التَّحْقِيقِ مِنْ آثَارِ الزَّنْدَقَةِ وَقَوْلُ أَهْلِ الْمُخَرِّفَةِ وَاللَّهُ الْمُسْتَعَانُ اه

“তথাকথিত সূফীরা উক্ত বিষয়ে এমন সব বিদআত সৃষ্টি করেছে, যেগুলোর হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। সঠিক পথের দাবীদারদের অনেকে উপর প্রবৃত্তি প্রাধান্য লাভ করেছে। সে ফলশ্রুতিতে অনেকেরই পক্ষ থেকে পাগল ও বালকসূলভ আচরণ, যেমন তালে তালে নৃত্য ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে। এর অশুভ পরিণতি এতদূর পর্যন্ত গড়ায় যে, তাদের কেউ কেউ একে ইবাদতে শামিল করে এবং আমলে সালেহ তথা পূণ্যকর্ম বলে সাব্যস্ত করে। আরো বলে যে, এটা অবস্থার উন্নতি সাধন করে। অতএব, নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, এগুলো চরম ইসলামবিদ্বেষী যিন্দিকদের প্রভাব এবং নির্বোধদের প্রলাপ”। -ফাতহুল বারী, ২/৩৬৮; রিসালাতুল মুসতারশিদীন এর টিকা, ১১৩-১১৪ আল্লামা শাতেবী i তার ‘আলইতসাম’গ্রন্থে আল্লামা আবূ বকর আজুররী থেকে উদ্ধৃত এক দীর্ঘ আলোচনার এক স্থানে উল্লেখ করেনঃ كَمَا يَفْعَلُ كَثِيرٌ مِنَ الْجُهَّالِ؛ يَصْرُخُونَ عِنْدَ الْمَوَاعِظِ وَيَزْعَقُونَ، وَيَتَغَاشَوْنَ ـ قَال: وَهَذَا كُلُّهُ مِنَ الشَّيْطَانِ يَلْعَبُ بِهِمْ، وَهَذَا كُلُّهُ بِدْعَةٌ وَضَلَالَةٌ • ওয়াজ নসীহতের সময় অধিকাংশ মুর্খরা যে চিৎকার করে উঠে লাফ-ফাল দেয়, মাতাল মাতাল ভাব করে, এ সবই শয়তানী কর্মকান্ড। শয়তান ওদের সাথে খেলা করে। এগুলো বিদআত ও ভ্রষ্টতা। -আলইতিসাম, ১/৩৫৬ ইলমে তাসাওউফের প্রসিদ্ধ ইমাম ইমাম শাইখ সোহরাওয়ার্দী i তার “আওয়ারিফুল মাআরিফ’গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করে লিখেনঃ “এ ব্যাপারে গোনাহের ব্যাখ্যা হবে অনেক দীর্ঘ। (জিকিরকারী বা জিকিরের মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তি) আল্লাহ তাআলাকে ভয় করবে। ইচ্ছেপূর্বক সামান্যও নড়বে না। (লাফালাফি, নাচানাচি করবে না) তবে যদি তার অবস্থা এমন রোগীর মত হয়, যে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া ইচ্ছে করলেও বন্ধ করতে পারে না। কিংবা হাঁচিদাতার মত হয়, যে হাঁচিকে রোধ করতে পারে না, অথবা তার নড়াচড়া যদি শ্বাসের ন্যায় হয়ে যায়, যে শ্বাস গ্রহণে সে প্রকৃতিগতভাবে বাধ্য (তাহলে ভিন্ন কথা)”। -আওয়ারিফুল মাআরিফ, ১১৮-১১৯

কথিত আছে, প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সীরীন i বলেন, যে সকল লোক তেলাওয়াত শুনে চিৎকার চেঁচামেঁচি করে উঠে, লাফালাফি করতে থাকে, তাদের পরীক্ষা এভাবে হতে পারে যে, তাদের একজনকে দেয়ালের উপর বসিয়ে দাও। আর এমতাবস্থায় কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতের ব্যবস্থা কর। এরূপ পরিস্থিতিতেও যদি সে ওয়াজদ তথা বিশেষ অবস্থার কারণে দেয়াল হতে পড়ে যায়, তাহলে বুঝা যাবে যে, সে ওয়াজদের দাবিতে সত্যবাদী। -মাজমূউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া, ১১/৭-৮; আলইতিসাম, ১/৩৪৮-৩৫৮

চরমোনাই তরীকার লোকেরা এমন করে কেন? আসলে চরমোনাই হুজুরদের বয়ানে যেভাবে কবরের, হাশরের, জাহান্নামের হালাতকে হৃদয়কাঁড়া, মর্মস্পর্শী বর্ণনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়, তা অন্য কারো বয়ানে সচারচর দেখা যায় না। তাই স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিরা এভাবে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে পাগলামী, লাফালাফি করে থাকে। তবে যদি ইচ্ছেকৃত এমনটি করে থাকে, তাহলে লোকটি সুনিশ্চিত ফাসিক এবং গোমরাহ। এ লোক পথভ্রষ্ট হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশও নেই। কিন্তু অপারগ হয়ে এমনটি করে থাকলে তাকে মাজূর মনে করা হবে। তার ব্যাপারে কটুবাক্য বলা, সমালোচনা করা উচিত হবে না। তবে এভাবে লাফালাফি করা যে, সর্বোত্তম পন্থা নয়, এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। বরং সবর ও ধৈর্যের সাথে একাকিত্বে আল্লাহ তাআলার কাছে কান্নাকাটি করা, অশ্রু বিসর্জন দেয়া সর্বোত্তম পন্থা।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১১ এপ্রিল, ২১