একাত্তর সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে মারা যাওয়া মুসলমানগণ কি শহীদ নয়

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসমৃত্যু ও আনুষঙ্গিক১৩ এপ্রিল, ২৩

প্রশ্ন

৭১ সালে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা যাওয়া বাঙ্গালীরা কি শহিদ হিসেবে পরিগণিত হবে? তারা তো ইসলামের জন্য যুদ্ধ করেননি। করেছেন আসাবিয়্যার জন্য, কুফফারদের বেঁধে দেয়া সীমানা আদায়ের জন্য। একইভাবে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে নিহত হওয়া ব্যক্তিরাও কি শহিদ হিসেবে গন্য হবেন?

https://ahlehaqmedia.com/404 অনেকে বলেন অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে গিয়ে আমরা গেলে শহিদ। অথচ আপনাদের এই জবাবে তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা প্রতিরোধ করতে গিয়ে মারা যাওয়াকে শহিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। জানাবেন আশা করি। জাযাকাল্লাহ খায়রান।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

আপনার প্রশ্নটিতে ৩টি বিষয় রয়েছে। যথা- ১– একটি প্রশ্ন আছে, আর তাহল, ভাষার জন্য এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তারা শহীদ কি না? ২ একটি অজ্ঞতা আছে। সেটি হল, কাফেরদের কর্তৃক সীমানা রক্ষায় একাত্তরে যুদ্ধ হয়েছে। ৩ আমাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে। সেটি হল, আমরা ইতোপূর্বের পোষ্টে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা মারা যান, তাদের শহীদ বলিনি। তিনটি পয়েন্টের আলাদা জবাব উদ্ধৃত হল, ১ নং এর জবাব নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলা ব্যক্তির অধিকার। জুলুমহীনভাবে স্বীয় ভূখন্ডে বসবাস করা প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার। সেই অধিকার থেকে যারা অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করতে চেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে যাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে তারা যদি মুসলমান হয়ে থাকেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি শহীদ বলে গণ্য হবে। মুসলমান না হলে উক্ত ব্যক্তিকে শহীদ বলা যাবে না। কারণ শহীদ এটি কোন রাজনৈতিক শব্দ নয়। এটি ইসলামী শরীয়তের একটি বিধান সম্বলিত পরিভাষা। এটি কেবল মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য। বিধর্মীদের জন্য নয়। বিধর্মীদের তাদের ধর্মীয় গ্রন্থে এভাবে মারা গেলে যা বলা হয়, তা বলবে, ইসলামী শরীয়তের পরিভাষা চুরি করা কেন? শহীদ ইসলামী দৃষ্টিতে খুবই মর্যাদাবান ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। এটি ইসলামের নিজস্ব পরিভাষা। শহীদ মৃত্যুবরণ করার সাথে সাথেই জান্নাতের নেয়ামত ভোগ করতে থাকে। শহীদ কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিভাষা নয়। তাই এটার যত্রতত্র ব্যবহার কিছুতেই কাম্য নয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, নাস্তিক-মুরতাদ সকলের জন্যই এ শব্দ ব্যবহার করা একটি ধৃষ্টতা বৈ কিছু নয়। শহীদ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই? ইসলাম নির্ধারিত একটি ইবাদত সম্পর্কিত শব্দকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহারতো ইসলাম অবমাননার শামিল। বিশেষ করে যারা নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী কিংবা রাজনৈতিক হীন লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে মারা গেছে তাদের শহীদ বলাটা ইসলামের এ মর্যাদাপূর্ণ শব্দকে নিয়ে তামাশা করা ছাড়া আর কিছু নয়। এভাবে মারা গেলে যে ব্যক্তি যে ধর্ম পালন করে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ অনুপাতে উক্ত ব্যক্তি যা বলা হয়, তাই বলা উচিত। অন্যদের ধর্মীয় পরিভাষা চুরি করা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য কাজ হতে পারে না।

عن سعيد بن زيد عن النبى -صلى الله عليه وسلم- قال : « من قتل دون ماله فهو شهيد ومن قتل دون أهله أو دون دمه أو دون دينه فهو شهيد হযরত সাঈদ বিন যায়েদ থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেছেন-“যে ব্যক্তি নিজ সম্পত্তি রক্ষায় নিহত হয় সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজ পরিবার রক্ষায় নিহত হয় সেও শহীদ। অথবা প্রাণ রক্ষায় কিংবা দ্বীন রক্ষায় নিহত হয় সেও শহীদ। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৭৭৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৬৫২ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত অবস্থায় যারা শহীদ হন তাদের বলা হয় শহীদ। এটা হল সত্যিকার শহীদ। রাসূল c কতিপয় ব্যক্তিকে হুকুমের দিক থেকে শহীদ বলেছেন। প্রকৃত শহীদ নয় বরং শহীদের কাছাকাছি মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। যেমন হাদীসে রয়েছে-

أن جابر بن عتيك أخبره :أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال الشهداء سبعةسوى القتل في سبيل الله المطعون شهيد والغرق شهيد وصاحب ذات الجنب شهيد والمبطون شهيد والحرق شهيد والذي يموت تحت الهدم شهيد والمرأة تموت بجمع شهيد হযরত জাবের বিন আতীক e থেকে বর্ণিত। রাসূল c ইরশাদ করেছেন-আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও সাত প্রকার শহীদ রয়েছে। ১-মহামারীতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ২-পানিতে নিমজ্জিত শহীদ। ৩-শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত শহীদ। ৪-পেটের রোগ মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৫-আগ্নিদগ্ধ ব্যক্তি শহীদ। ৬-যে ব্যক্তি ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে মারা যায় সেও শহীদ। ৭-সন্তান প্রসব করতে মারা যাওয়া নারীও শহীদ। -মুয়াত্তা মালিক, হাদিস নং-৫৫৪, ৮০২, আল মু’জামুল কাবীর, হাদিস নং-১৭৮০, সহীহ কুনুজু সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ, হাদিস নং-২৩ সুতরাং যেসব মুসলমান একাত্তরে নিজের প্রাণ ও পরিবার ও ন্যায্য অধিকার রক্ষায় মারা গেছেন তারা শহীদ। যা উপরোক্ত হাদীসের আলোকে পরিস্কার ভাষায়ই বুঝে আসছে। ২ নং এর জবাব আসলে আপনার এ ধারণাটি ভুল। আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস হয়তো ভাল করে পড়েননি। পড়লে একথা বলতেন না যে, শুধু সীমানা রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেছে। কোন সীমানা রক্ষায় মারা গেছে তারা? সে সময়তো পুরোটাই ছিল পাকিস্তান। তাহলে কার সীমানা রক্ষায় মারা গেছেন তারা? আসলে সীমানা নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা ব্যক্তিদের এক রোখা নীতি, পূর্ব পাকিস্তানের উপর তাদের নিপিড়ণ, জুলুম, শোষণ, হত্যা, লুণ্ঠন এবং ধর্ষণের প্রতিবাদ ছিল একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম। শুধু সীমান্ত রক্ষার কথা বলা বোকামী বৈ কিছু নয়। যেহেতু জুলুম, নিপীড়ণের প্রতিবাদে যুদ্ধ হয়েছে। তাই সে সময় যেসব মুসলমান জুলুমের প্রতিবাদে সংগ্রাম করে মারা গেছেন তারা স্বীয় সম্পদ, স্বীয় পরিবার রক্ষায় মৃত্যুবারণকারী হুকমী শহীদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হবে। ধর্মের জন্য মারা যাওয়া ব্যক্তিকে আসল শহীদ বলা হয়। যা’ই মূল। কিন্তু সম্পদ, পরিবার, জুলুমের প্রতিবাদে ইন্তেকাল করলেও উক্ত ব্যক্তিকে হুকমী শহীদের মর্যাদা দিয়ে রাসূল c ঘোষণা দিয়েছেন। তাই সে সময় মৃত্যুবরণকারী মুসলমানরা শহীদ হিসেবেই গণ্য হবেন ইনশাআল্লাহ। এটিকে শুধু সীমানা রক্ষার যুদ্ধ বলাটা কিছুতেই সমীচিন হবে না। ৩ নং এর জবাব আসলে আপনি যে লিংক দিয়েছেন আমাদের প্রকাশিত পোষ্টের। সেটি যে কেউ পড়লেই বুঝে যাবে আপনার এ অভিযোগটি ঠিক নয়। কারণ উক্ত পোষ্টের শেষে পরিস্কার ভাষায় লেখা আছে- “তবে যদি কোন মুসলমান রাষ্ট্রীয় সংবিধান মেনে আইনসম্মত প্রতিবাদ জানায়, আর তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়,তাহলে মজলুম হয়ে মৃত্যুবরণ করার কারণে উক্ত ব্যক্তিকে শহীদ বলা যাবে।” এ বক্তব্যটি উপরোক্ত লিংকের পোষ্টের শেষে পরিস্কার ভাষায় লিখা আছে। সেখানে আপনি কি করে বলছেন যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যারা মারা গেছেন তাদের আমরা শহীদ বলিনি? এটিতো আমাদের বিরুদ্ধে হয়তো না বুঝার কারণে ভুল অভিযোগ। অথবা ইচ্ছেকৃত অপবাদ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন। সীমা লঙ্ঘণ ও সীমা সংকোচনহীনভাবে ইসলামী শরীয়তের পূর্ণ পাবন্দ হবার তৌফিক দান করুন। আমীন।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৩ এপ্রিল, ২৩