এক মাযহাব মানা মানে কি শুধু এক ব্যক্তিকে মানা

আহলে হ্বক বাংলা মিডিয়া সার্ভিসআকীদা১৫ এপ্রিল, ২৩

প্রশ্ন

১ আমরা বলে থাকি যে, যে কোন একটি মাযহাব মানতে হবে।

তাহলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমরা ইমাম আবু ইউছুফ i এর মতকে গ্রহণ করেছি আবু হানিফা i এর মতকে ছেরে। বা আমরা ইমাম আবু মুহাম্মাদ i এর মতকে গ্রহণ করেছি আবু হানিফা i এর মতকে ছেরে।

এমন কেন?

২ ইমাম আবু হানিফা i কি তত কালিন যুগের আলেম-ওলামাদের নিয়ে কোন বোর্ড গঠন করেছিলেন কি? রেফারেন্স সহ উত্তর দিলে ভালো হত।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

১ নং প্রশ্নের জবাব আপনার মনে এ প্রশ্নটি উদয় হয়েছে মূলত মাযহাবের হাকীকত আপনার সামনে পরিস্কার না থাকার কারণে। মাযহাব বলা হয় পথকে। যে পথ কুরআন ও সুন্নাহের মূলনীতি অনুসরণ করে আল্লাহ তাআলার দেয়া শরীয়ত পালন করে থাকে। সেই পথের একটির নাম মাযহাবে হানাফী। হানাফী মাযহাব মানে শুধু ইমাম আবু হানীফা i এর কথা নয়। বরং ইমাম আবু হানীফা i এবং তার ফিক্বহী বোর্ডের প্রণীত সম্মলিত বা অধিকাংশের সিদ্ধান্তের নাম। ফিক্বহে হানাফী শুধু ইমাম আবু হানীফা i এর বক্তব্য নির্ভর ফিক্বহ নয়। বরং একটি গবেষক দলের গবেষণার নাম। যাদের মূল শায়েখ হলেন ইমাম আজম আবু হানীফা i । এক বিষয়ে সহীহ ও গায়রে সহীহ হাদীস থাকলে যেমন সহীহ হাদীস রেখে গায়রে সহীহ হাদীসের উপর আমল করা জায়েজ নয়। তেমনি ফিক্বহের মাঝে মুফতাবিহী ও গায়রে মুফতাবিহী দু’টি বক্তব্য থাকলে গায়রে মুফতাবিহী মাসায়েলের উপর ফাতওয়া দেয়া জায়েজ নয়। আর একটি মাযহাব মানতে বলার উদ্দেশ্য হল, একই মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত মাযহাব মানতে হবে। একাধিক মাযহাব একসাথে মানা মনের পূজা হয়ে থাকে। তাই এক মাযহাব মানে হল এক মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত গবেষকদের গবেষণাকে মেনে চলা। কোন ব্যক্তি বিশেষকে নয়। তাই আমরা শুধু ইমাম আবু হানীফা i এর গবেষণাকেই প্রধান্য দেই না, বরং ফুক্বাহায়ে আহনাফের গবেষক বোর্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা অধিকাংশের সিদ্ধান্ত তথা মুফতাবিহী তথা গ্রহণযোগ্য মতটি গ্রহণ করি। সকল মত নয়। যেমন সহীহ জঈফ হাদীসের মাঝে সহীহ হাদীস গ্রহণ করে থাকি। একটি জরুরী জ্ঞাতব্য! অনেকেই ইমাম আবু হানীফা i এর মতের উপর ফাতওয়া গ্রহণ না করে ইমাম আবু ইউসুফ i এবং ইমাম মুহাম্মদ প্রমুখদের ফাতওয়া গ্রহণ করার বিষয়টি মানুষের সামনে এভাবে উপস্থাপন করেন যে, ইমাম আবু হানীফা i এর কথা তার ছাত্র আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ i ই মানেননি। তাই তারা বিরোধিতা করেছেন তার মতের। জবাব এমন কথা যারা বলে থাকেন, তারা আসলে বিরোধিতা আর গবেষণার অর্থই বুঝেন না। এ বিষয়ে দু’টি পয়েন্ট ভাল করে বুঝতে হবে। যথা-

১ ইমাম আবু হানীফা i যদি শুধু নিজের মতকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন তাহলে তার ছাত্রদের নিয়ে বোর্ড গঠন করে মাসআলার সমাধান করার কাজ হাতে নিতেন না। বরং আলবানী i এর মত ইচ্ছেমত নিজের একটি মত লিখে সেটিই জাতির সামনে উপস্থাপন করে দিতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা এবং কুরআন ও সুন্নাহের সঠিক উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহের সামনে আসুক তিনি সেটিই চেয়েছিলেন। তাই তিনি বোর্ড করে গবেষণা করে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত প্রদাণ করতেন। যা পরিস্কার বুঝায় আমরা একজন ব্যক্তিকে নয় বরং গবেষক বোর্ডের ফাতওয়া মানি। নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নয়।

২ মূলত অন্যদের কথার উপর ফাতওয়া হলেও সেটিও ইমাম আবু হানীফা i এর বক্তব্যই থাকে। কারণ তিনি যখন কোন মাসআলাকে উপস্থাপন করতেন, তখন সেই মাসআলার সম্ভাব্য হুকুম বলে দিতেন। যেমন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ইত্যাদি। তারপর সবার মতামত জানতে চাইতেন। তখন উপস্থিত ফক্বীহগণ তাদের নিজেদের ইলম ও সমঝের আলোকে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতেন। এর মাঝে সব ক’টি বিষয়ই ইমাম আবু হানীফা i এর উপস্থাপিত হুকুম। কিন্তু তিনি নিজেও একটি হুকুমকে প্রাধান্য দিতেন। বাকিরাও তাদের মতকে বলতেন। তখন যার মতটি অধিক দলীল সমৃদ্ধ ও যৌক্তিক মনে হয় সেটির উপর সিদ্ধান্ত হতো। সেটিই ফিক্বহে হানাফী হিসেবে স্বীকৃতি পেত। আর সবাই যে মতগুলো দিত সেগুলো একেতো ইমাম আবু হানীফা i এরই একাধিক মতের একটি। আর দ্বিতীয়ত সবাই সেসব বিধানগুলো বলতেন ইমাম আবু হানীফা i এরই মূলনীতি অনুসরণ করে। তাই ইমাম আবু হানীফা i এর এক মতের উল্টো ফাতওয়া হওয়ায় সেটির দ্বারা ইমাম আবু হানীফা i এর বিরোধিতা প্রমানিত হয় না। বরং ইমাম আবু হানীফা i এর কথা এবং মূলনীতিই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। তাই এ অভিযোগ উত্থাপন করা আহমকী বৈ কিছু নয়।

২ নং প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ, ইমাম আবু হানীফা i রাসূল c এর জবানে বলা শ্রেষ্ঠ যুগের শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করেছিলেন। সেই বোর্ডের মাধ্যমে সংকলিত হয়েছে ফিক্বহে হানাফী। ইমাম আসাদ ইবনুল ফুরাত i (২১৩ হি.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানীফা i -এর চল্লিশজন সঙ্গী গ্রন্থসমূহ (ফিকহে হানাফী) সংকলন করেছেন। তাঁদের শীর্ষ দশজনের মধ্যে ছিলেন আবু ইউসুফ, যুফার, দাউদ ত্বয়ী, আসাদ ইবনে আমর, ইউসুফ ইবনে খালিদ ও ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া ইবনে আবী যাইদা। শেষোক্ত জন সিদ্ধান-সমূহ লিপিবদ্ধ করতেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।’-ইবনু আবিল ‘আওয়াম-এর সূত্রে যাহিদ হাসান কাওছারী-ভূমিকা, নসবূর রায়াহ ১/৩৮। এ কারণেই হানাফী মাযহাবে ভুল ফাতওয়া থাকার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু বোর্ড থাকার কারণে আল্লাহ তাআলার রহমাতে সেই সন্দেহ অনেকাংশেই দূরিভূত হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ১৫ এপ্রিল, ২৩