ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া

ইসলামী জিন্দেগীনামায২৪ ফেব, ২১

প্রশ্ন

আমাদের এলাকায় লা-মাযহাবী কিছু লোক প্রচার করছে যে, ইমামের পিছে মুক্তাদীগণ সূরা ফাতিহা না পড়লে তাদের নামাযই হবে না এবং হানাফীগণ যেহেতু ইমামের পিছে সূরা ফাতিহা পড়ে না, সুতরাং তাদের নামায হয় না। একথা কতটুকু সহীহ্?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

লা-মাযহাবীদের একথা মেটেও সহীহ নয়। তারা যে হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে, তা ইমামের পিছে ইকতিদাকারীর ব্যাপারে মোটেও প্রযোজ্য নয়, বরং উক্ত হাদীস শুধুমাত্র ইমাম এবং একাকী নামায আদায় করার ব্যাপারে প্রযোজ্য। ইমামের পিছে মুসল্লীদের জন্য সূরা- পড়ার কোনরূপ অনুমতি কুরআন-সুন্নাহ্ এর মধ্যে নেই। বরং মুসল্লীদের জন্য ইমামের পিছে সূরা ফাতিহা বা অন্য কোন সূরা পড়া নিষেধ। মুসল্লীদের কর্তব্য ইমামের ক্বিরা‘আত জোরে হোক বা আস্তে সর্বাবস্থায় চুপ থাকা। দলীল নিরুরূপঃ

ইমাম বাগাবী i হযরত মিকদাদ e থেকে বর্ণনা করেন যে, কিছু লোক রাসূল c -এর পিছে সূরা-ক্বির‘আত পড়ত। এটাকে নিষেধ করার জন্য সূরা আ’রাফের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-

}وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ } [الأعرا: 204[

অর্থঃ যখন (নামাযে ইমাম কর্তৃক) কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা (মুসল্লীরা) চুপ থাকবে। [সূরা আ’রাফঃ ২০৪]

عن ابي هريرة رضي الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله تعالى عليه وسل: انما جعل الامام ليؤتم به فاذا كبر فكبروا واذا فرأ فانصتوا.

অর্থঃ হযরত আবু হুরাইরা e থেকে বর্ণিত -তিনি বলেন, প্রিয় নবী c ইরশাদ করেন, “নিশ্চয় (নামাযে) ইমাম এ জন্য বানানো হয়, যেন তাঁর ইকতিদা করা হয়। কাজেই যখন ইমাম সাহেব তাকবীর বলেন, তখন তোমরাও তাকবীর বল এবং যখন তিনি পড়েন, তখন তোমরা চুপ থাক।” ইমাম আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং এটা বিশুদ্ধ হাদীস। ইমাম ত্বাহাবী i ও এ জাতীয় হাদীস বর্ণনা করেছেন।

হযরত আবু হুরাইরা e ও কাতাদাহ্ কর্তৃক বর্ণিত মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় রয়েছে, ‘যখন ইমাম সাহেব পড়েন, তখন তোমরা চুপ থাক। উল্লেখ্য, সূরা ফাতিহা ও সূরা মিলানো উভয়টাই কিরা‘’আতের অন্তর্ভুক্ত।

عن علي رضي الله عنه قا: « سأل رجل النبي صلى الله عليه وسل: أقرأ خلف الإمام أم أنصت ؟ قا: » لا بل أنصت فإنه يكفيك. (القراءة خلف الإمام للبيهق:1 / 407 برق:354)

হযরত আলী e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি প্রিয়নবী c -কে জিজ্ঞাসা করেন- “(ইয়া রাসূলাল্লাহ !) ইমামের পিছনে আমি কি সূরা বা পড়ব, নাকি চুপ থাকব? জবাবে, নবীজী c বললেন- না, বরং চুপ থাকবে, এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।” [বাইহাকী শরীফ]

قال وأخبرني موسى بن عقبة أن رسول الله صلى الله عليه و سلم وأبو بكر وعمر وعثمان كانوا ينهون عن القراءة خلف الإمام. -مصنف عبدالرزا:2 / 139

অর্থঃ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকের বর্ণনায় আছে) প্রিয়নবী c , আবু বকর, উমর ও উসমান e লোকদেরকে ইমামের পিছনে সূরা- পড়তে নিষেধ করতেন।

من قرأ خلف الامام فلا صلوة له.

অর্থঃ (হযরত আমর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে যায়িদ ইবনে সাবিত থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন,) যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে পড়বে, তার নামাযই হবে না।

মুহাম্মদ i ও আব্দুর রাজ্জাক i হযরত আলী e থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

عن النبي صلى الله تعالى عليه وسل: فإن من كان له امام فقراءة الامام قراءة له.

অর্থঃ হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ e “প্রিয়নবী c থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ইমামের ইকতিদা করেছেন, তার ইমামের সূরা-কিরা‘আ’তই তার জন্য সূরা- হিসেবে গণ্য হবে।” ইবনে মাজাহ i হাদীসটি বর্ণনা করেছেন হযরত আনাস e থেকে এবং দারাকুতনী বর্ণনা করেছেন আবু হুরাইরা e থেকে।

عن ابن عمر رضي الله تعالى عنه قا: سئل رسول الله عن القراءة خلف الامام فقال الامام يقرأ.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর e বলেন- প্রিয়নবী c -কে ইমামের পিছনে সূরা- পড়া সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়, জবাবে প্রিয়নবী c বলেন- শুধু ইমামই পড়বে। [বাইহাকী শরীফ]

عن ابن عمر انه كان اذا سئل هل يقرأ احد مع الامام قال اذا صلى احدكم مع الامام فحسب قراءة الامام....الخ.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর e থেকে বর্ণিত আছে, যখন তাঁকে এ প্রশ্ন করা হত- ইমাম সাহেবের সঙ্গে অন্য কেউ সূরা- পড়বে কি? জবাবে তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে যখন কেউ ইমামের সঙ্গে নামায পড়বে, তখন তার জন্য ইমামের কিরা‘আতই যথেষ্ট। আর হযরত ইবনে উমর e স্বয়ং ইমামের সঙ্গে সূরা- পড়তেন না। [মুআত্তা ইমাম মুহাম্মদ রহ.]

عن ابن عباس قال قال رسول الله صلى الله تعالى عليه وسل: كل صلوة لا يقرأ فيها بفاتحة الكتاب فلا صلوة إلا وراء الامام.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- প্রিয়নবী c ইরশাদ করেছেন, “যে নামাযে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা হয় না, তা (পূর্ণ) নামাযই নয়। তবে যদি ইমামের পিছনে হয়, সেটা ভিন্ন কথা।” হাদীসটি ইমাম বায়হাকী i নিজ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

عن ابن عمر رضي الله عنه ان رسول الله نهى عن القراءة خلف الامام.

অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- প্রিয়নবী c ইমামের পিছনে সূরা- পড়তে নিষেধ করেছেন। ইমাম বাইহাকী i পক্ষান্তরে ইমামের পিছনে সূরা পড়ার ব্যাপারে যে বর্ণনা পেশ করা হয়। যেমনঃ

عن ابي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من صلى صلوة لم يقرأ فيها بأم القرآن فهي خداج فهي خداج فهي خداج.

অর্থঃ হযরত আবু হুরাইরা e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- প্রিয়নবী c ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নামায পড়ল, অথচ সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করল না। সেটা অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ। সিহাহ সিত্তাহর ইমামগণ, ইমাম মালিক, আহমাদ, দারাকুতনী এবং বাইহাকী i হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

عن عائشة رضي الله تعالى عنه قالت قال رسول الله صلى الله تعالى عليه وسل: كل صلوة لا يقرأ فيها بأم الكتاب فهي خداج.

অর্থঃ হযরত আয়িশা e থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- প্রিয়নবী c ইরশাদ করেছেন, “যে নামাযে সূরা ফাতিহার তিলাওয়াত করা হয় না, তা অসম্পূর্ণ নামায।”ইবনে মাজাহ ইবনে আবী শাইবা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

এ হাদীস সমূহের ব্যাখ্যায় হযরত সুফিয়ান i বলেন যে, এ হাদীসগুলো একাকী নামায আদায়কারী ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ, ইমামের পিছে নামায আদায়কারীর ব্যাপারে নয়।

اما احمد بن حنبل فقال معنى قول النبي صلى الله عليه وسلم "لاصلوة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب "ঃاذا كان وحده. احتج بحديث جابر بن عبد الله حيث قال من صلى ركعة لم يقرأ فيها بام القرأن فلم يصل الا ان يكون وراء الامام.

অর্থঃ আহমদ বিন হাম্বল i বলেছেন- উল্লেখিত হাদীসটি একাকী নামায আদায়কারী ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। তিনি নিজের দাবীর ব্যাপারে হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ e - এর সেই হাদীসটিকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন, যে হাদীসে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি নামায পড়ল, অথচ সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, সে নামাযই পড়ল না। তবে যদি ইমামের পিছনে হয় তাহলে তার জন্য সূরা ফাতিহা পড়তে হবে না।

অতঃপর ইমাম আহমাদ i আরো বলেছেন- লক্ষ্য করুন ! প্রিয়নবী c -এর একজন সাহাবী হযরত জাবির e এরূপ হাদীসের এ ব্যাখ্যাই করেছেন যে, সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায পূর্ণ হয় না, এ হাদীসটি মুনফারিদ বা একাকী নামায আদায়কারীর জন্য প্র্রযোজ্য।

উল্লেখিত বর্ণনা সমূহের দ্বারা ইমামের পিছনে কোন সূরা- এবং সূরা ফাতিহাও না পড়ার কথা প্রমাণিত হয়। সে ভিত্তিতেই হানাফীগণ যে ইমামের পিছনে সূরা- পড়েন না, তা যথার্থ ও সহীহ। এ সম্পর্কে লা-মাযহাবীদের দাবী ভিত্তিহীন ও অমূলক।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২৪ ফেব, ২১