ইজমা, ক্বিয়াস পরিত্যাগ করার পরিণতি

ইসলামী জিন্দেগীসভ্যতা ও সংস্কৃতি২২ ফেব, ২১

প্রশ্ন

যদি কোন ব্যক্তি কেবলমাত্র কুরআন ও হাদীস মান্য করে এবং সে অনুসারে আমল করে । আর ইজমা-ক্বিয়াসের ক্ষেত্রে নিজের বিবেককে প্রাধান্য দেয়, তাহলে ব্যাপারটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে?

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। কুরআন ও হাদীসে প্রতিটি বিষয়ে সমাধান পাওয়া যায়। এমন কোন বিষয় নেই, যার সমাধান কুরআন-হাদীসে নেই। তবে কুরআন-হাদীসে কিছু আহকাম বা বিষয় এমন রয়েছে, যেগুলো বুঝতে কারো কোন অসুবিধা হয় না। যারা আরবী অর্থ বুঝতে সক্ষম, তারা কুরআন হাদীসের সে সব স্পষ্ট আহকাম ও ‍বিষয়গুলো বুঝতে পারেন এবং সর্বসাধারণও যদি এর বাংলা অর্থ পড়ে বুঝতে চায়, তাহলে তারাও সেগুলো বুঝতে পারবে। এর জন্য কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না বা কারো অনুসরণ-অনুকরণ করার প্রয়োজনও হবে না।

আবার সেখানে এমন কিছু বিষয়ও রয়েছে, যার শুধু ‍দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর কিছু ‍বিষয় আছে যার একাধিক অর্থ রয়েছে; তার কোন ব্যাখ্যা বিস্তারিত বিবরণ বর্ণনা করা হয়নি এবং কুরআন-হাদীসে এমনও কিছু বিষয় রয়েছে, যা বাহ্যিকভাবে পরষ্পর বিরোধী বুঝা যায়; কিন্তু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলে তাতে কোন বিরোধ থাকে না। এগুলোর সমাধানের জন্য হয়তো প্রত্যেকে নিজের জ্ঞান অনুযায়ী ফায়সালা বা সমাধান করে সে অনুযায়ী আমল করবে।

অথবা নিজেরা কোন ফায়সালা না করে আমাদের পূর্বসূরী মুজতাহিদীন (যাঁদের কুরআন ও হাদীসের সার্বিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছিল) এ সমস্ত বিষয়ের কি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন এবং এগুলোর কি সমাধান দিয়েছেন, সে ফায়সালা অনুযায়ী আমল করবে। এ দুটির যে কোন একটি পথ অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। তবে স্মরণীয় বিষয় হল, এসমস্ত বিষয়ের নিজে নিজে সমাধান বের করে আমল করা আমাদের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার। কারণ, কুরআন-হাদীসের সার্বিক বিষয়ের ইলম আমাদের নেই এবং ইজতিহাদ করে সমাধান বের করার মত যোগ্যতাও আমাদের নেই।

সুতরাং মুজতাহিদীনের পদাংকানুসরণ আমাদের করতে হবে। আর এ ব্যাপারে তাদের অনুসরণ মূলত কুরআন-হাদীস তথা আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলেরই অনুসরণ করার নামান্তর। কুরআন-হাদীসে মুজতাহিদীনে কিরামের অনুসরণ করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন-“তোমরা আহলে যিকিরদের কাছে জিজ্ঞাসা কর; যদি তোমাদের জানা না থাকে ।”

অর্থাৎ যারা বিধি-বিধানের জ্ঞান রাখে না তারা, যারা জানে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিবে এবং তাদের কথামত আমল করবে।

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন- “তোমরা আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং তোমাদের মধ্যে যারা উলূল আমর, তাদের অনুসরণ কর।” [সূরা ‍নিসাঃ ৫৯]

বিশিষ্ট সাহাবী ইবনে আব্বাস e , জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ e এবং বিশিষ্ট তাফসীরকারগণ উক্ত আয়াতে “উলূল আমর” –এর দ্বারা উদ্দেশ্য মুজতাহিদ ইমাম বলে উল্লেখ করেছেন।

অতএব, যেসব বিধান কুরআন-হাদীসে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই অথবা যেগুলো কুরআনী আয়াতে বা হাদীসে বাহ্যতঃ পরষ্পর বিরোধী বলে মনে হয় সেসব বিধি-বিধান এর ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী সাধারণ লোক থেকে শুরু করে নিজে মুজতাহিদ নয়-এমন আলিমের জন্য একজন মুজতাহিদের অনুসরণ করা জরুরী।

ব্যক্তিগত অভিমতের (কিয়াসের) ভিত্তিতে একটি আয়াত কিংবা হাদীসকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেটাকে গ্রহণ করা এবং অন্য আয়াত বা হাদীসকে বর্জন করা ও তার উপর আমল ছেড়ে দেয়া তাদের জন্য বৈধ হবে না।

কেননা, কুরআন-সুন্নাহ এ যেসব বিধান পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই, সেগুলো কুরআন-সুন্নাহের বর্ণিত মূলনীতি অনুসরণ করে বের করা হয়েছে। আর এই মহান কাজটি সুসম্পন্ন করেছেন এমন মুজতাহিদীন যারা আরবী ভাষায় ও কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষতাসম্পন্ন। তাদের আল্লাহ ভীতি ও পরহেযগারী ছিল বর্ণনাতীত। এসব যোগ্যতা, দক্ষতা ও মর্যাদার বিষয় বিবেচনা করে উলামায়ে কিরাম প্রসিদ্ধ চারজন ইমামকে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনোনীত করেছেন।

কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে নবুওয়াত যুগের নৈকট্য এবং সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সংসর্গের বরকতে শরী‘আতের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য বুঝার বিশেষ জ্ঞান দান করেছেন। বর্ণিত বা স্পষ্ট বিধানের উপর যা বর্ণিত হয়নি বা অস্পষ্ট রয়েছে, সেগুলোকে কিয়াস করে শরী‘আত সম্মত ‍নির্দেশ বা বিধান বের করার মত অসাধারণ যোগ্যতা দান করেছিলেন। একারণেই পরবর্তীতে বড় বড় আলিম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণও আরবী ভাষা ও শরী‘আত সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা ইজতিহাদী মাসআলার ব্যাপারে সর্বদা উপরোক্ত ইমামগণের অনুসরণ করে গেছেন।

সুতরাং বর্তমান যুগে আলিমদেরকেও ইজতেহাদী মাসআলার ব্যাপারে যে কোন একজন ইমামের অনুসরণ করা অপরিহার্য কর্তব্য। ইমামগণের মতের বিরূদ্ধে কোন নতুন মত অবলম্বন করা বৈধ হবে না। কেননা, বর্তমানে ইলমের গভীরতা অনেকগুণ হ্রাস পেয়েছে। এমনিভাবে তাকওয়া, পরহেযগারী ও খোদাভীতিও পর্যায়ক্রমে বিদায় নিচ্ছে । এমন পরিস্থিতিতে ইমামদের অনুসরণ না করে দীনের উপর টিকে থাকা বা চলা সম্ভবপর নয়।

এমন মুহূর্তে নির্দিষ্ট একজনের অনুসরণ না করে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন জনের অনুসরণ করাও বৈধ হবে না। কারণ, এ অনুমতি থাকলে মানুষ প্রবৃত্তি বা স্বার্থের অনুসারী হয়ে যাবে। যেখানে যার দ্বারা তার স্বার্থসিদ্ধী হবে, সে বিষয়ে তাকেই অনুসরণ করবে। কাজেই চার ইমামের যে কোন একজন ইমামের অনুসরণ করার উপর উলামায়ে কিরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে একজনকে অনুসরণ করে বাকী ইমামদেরকে হক বা সত্য বলে মেনে নিতে হবে।

সুতরাং আজ যারা কুরআন-হাদীসের উপর আমল করার দাবী তুলে কারো অনুসরণ করা জরুরী মনে করছে না বা কারো অনুসরণ করাকে শরী‘আত বিরোধী মনে করে, তারা বিভ্রান্তিতে রয়েছে। আর দীনের নামে তারা মূলতঃ তাদের কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে এবং ভ্রান্ত মতবাদ মানুষের মাঝে ছড়ানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। এদের থেকে সকলের সতর্ক থাকা একান্ত কর্তব্য।

- والله اعلم باالصواب -

সূত্র

  • ফাতাওয়া শামী, খন্ড: , পৃষ্ঠা: ৭৭
  • তাকলীদ কী শরয়ী হাইসিয়্যাত, খন্ড: ১৬, পৃষ্ঠা: ২৫
  • সূরা: নিসা, আয়াত: ৫৯

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২২ ফেব, ২১