আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের মুখোশ উন্মোচন এবং তাদের ভ্রান্তি নিরসন

ইসলামী জিন্দেগীসভ্যতা ও সংস্কৃতি২২ ফেব, ২১

প্রশ্ন

আমাদের এলাকায় কিছু লোক আছেন যারা ‍নিজেদেরকে আহলে হাদীস বা সালাফী বলে দাবী করেন । নিজেদেরকে সঠিক আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত অভিহিত করে থাকেন। তারা চার মাযহাবের ইমামগণের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা রাখেন। ইমামগণের তাকলীদ করাকে শিরক বলে মন্তব্য করেন। তারা বলে বেড়ান যে, হাদীসের সাথে হানাফীদের নামাযের মিল নেই। বরং তাদের অধিকাংশ আামল হাদীস ও সুন্নতের খিলাফ; যেমন-হানাফীরা রফয়ে-ইয়াদাইন করেন না, ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহা পড়েন না, জোড়ে আমিন বলেন না ইত্যাদি । এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত একান্তভাবে কামনা করছি – যাতে করে এলাকার ভিতরে বিভ্রান্তি না ছড়ায় এবং সকলে শান্তিমত ইবাদত করতে পারি ।

উত্তর

- حامداومصلياومسلما، بسم الله الرحمن الرحيم -

রাসূল c থেকে কথা, কাজ ও সমর্থনমূলক যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তা সবই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত । যদিও তার সবটা উম্মতের আমলের জন্য নয়, যেমন- রাসূল c আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে একসাথে নয় জন বিবি রেখেছেন । এটা হাদীস তবে হাদীস হওয়া সত্ত্বেও উম্মতের জন্য এর অনুসরণ জায়িয নাই । কারণ এর অনুসরণ অন্য দলীলের ভিত্তিতে উম্মতের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে । উম্মতের করণীয় হিসেবে নবী c যা কিছু রেখে গেছেন, সেগুলো সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত । তবে সে প্রেক্ষিতে গাইরে মুকাল্লিদদের আহলে হাদীস নাম গ্রহণ করাটাই আপত্তিকর । কেননা আহলে হাদীসের অর্থ হল হাদীসের অনুসারী অথচ সব হাদীস উম্মতের আমলের জন্য নয় । বরং মহানবী c বিভিন্ন রিওয়ায়াতে আমাদেরকে সুন্নাহর অনুসরণ করারই আদেশ দিয়েছেন । যেমন রাসূল c ইরশাদ করেন- তোমরা আমার ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খলিফাগণের সুন্নাতকে অবলম্বন কর । তোমরা তাঁদের আদর্শ শক্তভাবে ধারণ কর ও দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর । [আবূ দাঊদ শরীফ ২ঃ ৬৩৫]

রাসূলুল্লাহ c আরো ইরশাদ করেন- আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি । যতদিন তোমরা তা শক্তভাবে আঁকড়ে রাখবে, কখনো পথভ্রষ্ট হবে না । একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (আল্-কুরআন) ও অপরটি হচ্ছে তাঁর রাসূল c এর সুন্নাত-আদর্শ ।

এ হাদীসের উপর ভিত্তি করেই হক পন্থীগণকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত নামে অভিহিত করা হয় ।

চার মাযহাবের ইমাম ও ফিকহের অন্যান্য মুজতাহিদ ফকীহ ইমামগণ এ উম্মতের মধ্যে অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন । সমগ্র আহলে হক তাদের মর্যাদা মেনে নিয়েছেন । সুতরাং তাদের সম্বন্ধে কোনরূপ বিরূপ মন্তব্য জায়িয নয় । একজন সাধারণ মুসলমানকে গালি দেয়া শরী‘আতে হারাম । সে ক্ষেত্রে এত বড় উঁচু দরজার উলামায়ে কিরাম এবং বুযুর্গগণকে গালী দেয়া বা বিরূপ ভাব রাথা অমার্জনীয় অপরাধ বৈকি ।

জটিল বা অস্পষ্ট বিষয় সমূহে ইমামগণের কোন একজনের তাকলীদ বা অনুসরণকে শিরক বলা মহা ‍অন্যায় এবং মুর্খতার বহিপ্রকাশ । কারণ-মাযহাবের অনুসারীগণ কখনও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের অনুসরণের মত এসব ইমামকে অনুসরণ করেন না । বরং জটিল ব্যাপার সমূহে বা যে ক্ষেত্রে বাহ্যিক ভাবে আয়াত বা হাদীস পরস্পর বিরোধী মনে হয়, শুধু সেক্ষেত্রেই তাদের ব্যাখ্যা অনুসরণ করা হয় । যা মূলতঃ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ । আর এক্ষেত্রে তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমল করা নিরাপদ । কেননা তারা নবী c - এর যামানার খুব নিকটবর্তী ছিলেন । যাদের অনেকে একাধিক সাহাবাগণের দর্শন লাভ করেছেন । যারা নবী c - এর সর্বশেষ আমল বা অভিমত সরাসরি সাহাবা e মারফত জানতে পেরেছিলেন । সেই প্রজ্ঞাশীল ফকীহ মাযহাবী ইমামগণের ব্যাখ্যা ও অভিমত আমাদের দীর্ঘ পিছনের সারির লোকগণের ব্যাখ্যার চেয়ে উত্তম ও বরণীয় হবে । তাই উল্লেখিত পন্থাটি অত্যন্ত সুন্দর, যু্ক্তিযু্ক্ত ও নিরাপদ । তা কোন বিবেকবান মানুষের নিকট অস্পষ্ট থাকতে পারে না । কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আলেমের অনুসরণ করার ধারা সাহাবাদের যুগ থেকে চলে আসছে । নবী c - এর হায়াতে তো সকলেই নবী c কে জিজ্ঞাসা করে বা তাকে দেখে আমল করতেন । কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর লক্ষাধিক সাহাবায়ে কিরাম থেকে মাত্র সীমিত সংখ্যক সাহাবা e মাসাআলা-মাসায়িল ও ফাতাওয়া দেওয়ার খিদমত আঞ্জাম দিতেন । সাধারণতঃ এক এক এলাকার লোকজন একজন ফকীহ সাহাবীর e ফাতাওয়া অনুযায়ী আমল করতেন । হাদীসের কিতাবে এর একাধিক বর্ণনা এসেছে । যেমন কূফাতে আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ e , মদীনায় যাইদ বিন ছাবিত e প্রমুখ ।

আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা এ তাকলীদ বা অনুসরণকে কি শিরক বলবেন । তাছাড়া পবিত্র কুরআনের সাতজন ক্বারীর কিরাআতে সাব‘আ প্রসিদ্ধ । তারা নিজেরা নিশ্চয়ই সাত কিরাআতের কোন নির্দিষ্ট একটা কিরাআত অবলম্বন করে কিরাআত করে থাকেন । অর্থাৎ সাত কারীগণের থেকে শুধুমাত্র একজন কারীকে অনুসরণ করে থাকেন । তাদের কথামত এটা কি শিরক হবে ? যাই হোক ইমামের তাকলীদ বা অনুসরণ সাহাবাগণের e যামানা থেকে চলে আসছে । এটাই স্বাভাবিক নিয়ম । দুনিয়ার দিক দিয়েও আমরা সাধারণতঃ প্রত্যেক ব্যাপারে ঐ বিষয়ের পারদর্শী লোকদের তাকলীদ বা অনুসরণ করে থাকি । ইচ্ছামত কাজ করি না । যেমন বিল্ডিং তৈরি করতে হলে ইঞ্জিনিয়ারের স্মরণাপন্ন হতে হয় । যে কোন কাজ বুঝতে একজন নির্দেশক মানতে হয় । তেমনিভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূ্র্ণ হল-দীন । এ দীন তথা কুরআন হাদীসের ব্যাখ্যার ব্যাপারে সবচেয়ে যারা বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাদের ব্যাখ্যা মেনে নেওয়াটাই তো নিরাপদ । আর মহান আল্লাহ তা‘আলা তো সেই নির্দেশই দিয়েছেনঃ “তোমরা না জানলে, যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর ।” এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে নবী c আকাবিরে সাহাবাগণের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন ।

ইমামগণের মতামত বাদ দিয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত কুরআন হাদীসের ব্যাখ্যা দেয়া এবং মাযহাব মানাকে অস্বীকার করা শরী‘আতের মধ্যে মারাত্মক বিদ‘আত বলে আহলে হকগণ উল্লেখ করেছেন । কারণ, কথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ৫৪২ হিজরীর পর হয়েছে । বরঞ্চ অনেকে তো তথাকথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের মধ্যে গণ্য হওয়া দীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তা বা মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করেছেন । সুতরাং তাদের নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বলে দাবী করা অবান্তর । মোদ্দাকথা, ফকীহ সাহাবাগণের তাকলীদ স্বয়ং অন্যান্য সাহাবাগণ করে গেছেন । ঐ সব ফকীহ সাহাবাগণের সমস্ত ফাতাওয়া ও আলোচনার বিবরণ-সারবস্তু আয়িম্মায়ে মুজতাহিদগণ সংরক্ষণ করেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐ সকল ফকীহ সাহাবাগণের বর্ণনার আলোকে বুনিয়াদী কানুন ও বিস্তারিত মাসায়িল পেশ করেছেন । সুতরাং ইমামগণের তাকলীদ প্রকৃতপক্ষে কুরআন-সু্ন্নাহ ও ফকীহ সাহাবাগণের ব্যাখ্যারই তাকলীদ বা অনুসরন । এটা কখনও ঐসব উলামাগণের ব্যক্তিত্বের তাকলীদ নয় যে, তাকে শিরক গণ্য করা হবে । যদি তা শিরক সাব্যস্ত হয়, তবে আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের জনসাধারণতো তাদের উলামাগণের কথামতই সব আমল করে থাকেন । সরাসরি কুরআন-হাদীস বুঝার ক্ষমতা নিশ্চয় তাদের নেই । তাহলে তাদের দৃষ্টিতে তারা নিজেরাই কি শিরকের শিকার গণ্য হবেন না । আহলে হাদীস দাবীদাররা প্রায় মাযহাব ওয়ালাগণের ব্যাপারে কটাক্ষ ও বিরূপ সমালোচনা করতে থাকেন। যা কোন শরীফ সম্ভ্রান্ত লোকের শান নয় । অপরদিকে হানাফীগণ একান্ত নিরূপায় হয়ে তাদের ভুল তথ্যের জবাব দিতে বাধ্য হন ।

হাদীসের সাথে হানাফী মাযহাবের অনুসারীদের নামাযের সামঞ্জস্য না থাকার অভিযোগ ভিত্তিহীন, অবান্তর ও তাদের স্থূলদৃষ্টির পরিচায়ক । কেননা, সহীহ বিশুদ্ধ একাধিক হাদীসে রফ’য়ে ইয়াদাইন একবার শুধু তাকবীরে তাহরীমা করার সময় উল্লেখ আছে । অনেক সহীহ হাদীসের ইমামের পিছনে কিরাআত বা সূরাহ ফাতিহা পড়া সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা এসেছে । হুজুর c - এর নামাযে আমীন নিঃশব্দে পড়েছেন বলে উল্লেখ আছে । এ সম্পর্কে কতিপয় হাদীস শরীফ নিম্নে উদ্ধৃত হলঃ

(ক) হযরত জাবির ইবনে সামু বলেন- (নামাযের মুহূর্তে সূলুল্লাহ c আমাদের নিকট আসলেন এবং বললেন- তোমাদের কি হল যে, তোমাদেরকে দেখতে পাচ্ছি-তোম রফ’য়ে ইয়াদাইন করছ দুর্দান্ত ঘোড়ার লেজের ন্যায় ? নামাযের মধ্যে শান্ত ও ধীর হও । [প্রমাণঃ সহীহ মুসলিম, ১ঃ ১৮১ # সুনানে আবূ দাউদ, ১ঃ ১০৯ # সুনানে নাসায়ী ১ঃ ১১৭]

(খ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ e বলেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ c -এর নামায সম্পর্কে অবগতি দেবো না ? একথা বলে তিনি নামায পড়ে দেখালেন এবং নামাযের তাকবীরে তাহরীমার সময় একবার রফ’য়ে ইয়াদাইন করলেন (দুহাত উত্তোলন করলেন) । নামাজের আর কোথাও তিনি রফ’য়ে ইয়াদাইন করলেন না। [প্রামাণঃ সুনানে নাসায়ী, ১ঃ ১১৭]

(গ) হযরত আবূ মূসা আল আশ‘আরী e বলেন নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ c আমাদেরকে ওয়ায-খুতবাহ শুনিয়েছেন। আমাদের জন্য সুন্নাত তরীকা বর্ণনা করেছেন এবং আমাদেরকে নামায শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ c ইরশাদ করেছেন- তোমরা স্বীয় কাতার সমূহ সোজা কর। অতঃপর তোমাদের একজন তোমাদের নামাযের ইমামতি করবেন । তিনি যখন তাকবীর বলেন, তোমরাও তাকবীর বলবে । আর তিনি যখন কিরাআত পড়বেন, তখন তোমরা চুপ থাকবে।[প্রমাণঃ সহীহে মুসলিম, ১ঃ১৭৪ # সুনানে আবু দাঊদ, ১ঃ ১৪০]

(ঘ) হযরত জাবির e বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ c ইরশাদ করেন- যার ইমাম আছে, সেই ইমামের কিরাআতই তার কিরাআত। [প্রমাণঃ সুনানে ইবনে মাজাহ, ৬১]

(ঙ) হযরত ‘আলক্বামা ইবনে ওয়াইল e স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, নবী কারীম c সূরা ফাতিহা শেষ করলেন তৎপর বললেন-আমিন । তখন আমীন আস্তে বললেন । [তিরমিযী]

এখানে কতিপয় দৃ্ষ্টান্ত পেশ করা হল। এরূপে হানাফীগণের প্রত্যেক আমলের মূলেই সহীহ হাদীস বিদ্যমান রয়েছে । প্রসিদ্ধ হাদীসের কিতাব ত্বাহাবী শরীফ হানাফী মাযহাবের অনুসরণীয় হাদীস সমূহ দ্বারাই সমৃদ্ধ । এতে বুঝা গেল-হানাফীগণের নামাযের প্রত্যেকটা আমল সহীহ রিওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত । বিস্তারিত জানতে চাইলে, “নসবুর রায়াহ” ,“আওজাযুল মাসালিক”, “ই’লাউসসুনান” প্রভৃতি কিতাব সমূহ দেখার জন্য অনুরোধ করছি ।

- والله اعلم باالصواب -

আনুষঙ্গিক তথ্য

ফতোয়া প্রদানের তারিখ: ২২ ফেব, ২১